
ছবি: সংগৃহীত
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ওপর বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সংগঠিত হামলার ঘটনায় প্রশাসনের গৃহীত তদন্তের ভিত্তিতে কঠোর শাস্তিমূলক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সোমবার (৪ আগস্ট) দিবাগত রাত সাড়ে ৩টায় এক সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান এসব সিদ্ধান্তের ঘোষণা দেন।
ঘোষণা অনুযায়ী, হামলার ঘটনায় সরাসরি জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে এমন ২২৯ জনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মাত্রার শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৩০ জন বর্তমান শিক্ষার্থী এবং ৯৯ জন সাবেক শিক্ষার্থী। সবচেয়ে গুরুতর শাস্তি হিসেবে ৬৪ জন বর্তমান শিক্ষার্থীকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে, অর্থাৎ তারা আর কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো একাডেমিক কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবে না।
বাকি ৩৭ জন শিক্ষার্থীকে দুই বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে, ৮ জনকে এক বছরের জন্য এবং একজনকে ছয় মাসের জন্য বহিষ্কৃত করা হয়েছে।
অন্যদিকে, সাবেক শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭৩ জনের সনদ সম্পূর্ণভাবে বাতিল করা হয়েছে, যার অর্থ তারা আর তাদের অর্জিত ডিগ্রি ব্যবহার করতে পারবেন না। এছাড়া আরও ৬ জনের সনদ দুই বছরের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছে। তবে তদন্তে অভিযুক্ত ২০ জন বর্তমান ও ২০ জন সাবেক শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে প্রমাণ না পাওয়ায় তাদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
উপাচার্য জানান, “বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি-নৈতিকতা ও একাডেমিক পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে আমরা কোনো আপস করিনি। অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কখনো সহিংসতা কিংবা রাজনৈতিক সন্ত্রাসকে প্রশ্রয় দেবে না।”
গত ১৭ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় একটি প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপনের পরই আলোচিত ওই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ২৮৯ জনকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছিল। যেসব শিক্ষার্থীর ছাত্রত্ব ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে, তাদের সনদ স্থগিত করা হয় এবং যেসব শিক্ষার্থী সেই সময় পরীক্ষা দিয়েছিলেন, তাদের ফলাফল স্থগিত রাখা হয়েছিল।
পরে অধিকতর তদন্তের জন্য একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেই সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়, কীভাবে আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর সুপরিকল্পিতভাবে হামলা চালানো হয়েছিল, যার নেতৃত্বে ছিল বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের একটি প্রভাবশালী অংশ।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, হামলার দিন ক্যাম্পাসে বহিরাগতদেরও প্রবেশ করানো হয়েছিল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্বল করে রাখা হয়েছিল। অভিযোগ রয়েছে, ঘটনার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রশাসন চুপ থেকেছে এবং অনেক ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছে বলেও প্রমাণ পাওয়া গেছে।
শুধু শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধেই নয়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। একইদিনে ঘোষণা করা হয়েছে, ঘটনার সময় দায়িত্বে থাকা ৯ জন শিক্ষককে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলম ও রেজিস্ট্রার আবু হাসানের পেনশন সুবিধা বাতিলের সিদ্ধান্তও সিন্ডিকেট সভায় অনুমোদন পেয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সিন্ডিকেট সদস্য জানান, “বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি তখনই দায়িত্বশীল আচরণ করতো, তাহলে হয়তো এত বড় পরিসরে সহিংসতা ছড়াত না। এখন প্রমাণসহ যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা নজিরবিহীন।”
ঘোষণার পর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। একদিকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ও শিক্ষক সংগঠনগুলো প্রশাসনের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও, ছাত্রলীগের একটি অংশ এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির এক সদস্য বলেন, “বহিষ্কার ও সনদ বাতিলের সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয়কে সহিংসতা ও অনৈতিক রাজনীতির ছায়া থেকে মুক্ত করতে সাহসী পদক্ষেপ।”
অন্যদিকে ছাত্রলীগের একাংশ বলছে, “বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রাজনৈতিক চাপে পড়ে একতরফাভাবে শাস্তি দিয়েছে। প্রকৃত সত্য উন্মোচনের আগে এত বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণ অনাকাঙ্ক্ষিত।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের এই পদক্ষেপ দেশের শিক্ষাঙ্গনে নতুন বার্তা দিয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সহিংসতা ও ছাত্র রাজনীতির নামে অপশক্তির বিরুদ্ধে এই নজির অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও সাহসী পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করবে বলে অনেকে মত দিয়েছেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ও টিআইবির মতো সংস্থাগুলোও এ সিদ্ধান্তকে সময়োপযোগী ও প্রশংসনীয় বলে মন্তব্য করেছে।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. কামরুল আহসান জানান, “এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলেও, কেউ যদি মনে করে তার বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তাহলে সে নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় আপিল করতে পারবে। আমরা ন্যায়বিচারের সব পথ উন্মুক্ত রেখেছি।”
এই কঠোর সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় একটি ঐতিহাসিক সময়ে প্রবেশ করল। দীর্ঘদিন ধরে চলা রাজনৈতিক প্রভাব, সহিংসতা ও ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে এটি কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে অনেকেই আশাবাদী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক এবং অভিভাবকদের প্রত্যাশা—এই শাস্তিমূলক পদক্ষেপের মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গনে একটি শান্তিপূর্ণ, সহনশীল ও শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ