
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে, অর্থাৎ রমজানের আগে অনুষ্ঠিত হবে—প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এই ঘোষণাকে ঘিরে দেশের রাজনীতিতে একধরনের স্পষ্টতা এসেছে। দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা, জল্পনা-কল্পনা ও রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিধার পর আজ দৃশ্যমান একটি সময়সূচি ঘোষণার মাধ্যমে পরিস্থিতি নতুন মোড় নিয়েছে। দেশের বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে এবং একে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করেছে।
বিএনপির প্রতিক্রিয়া: দ্বিধার অবসান
বৃহত্তর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এই ঘোষণাকে ‘দোদুল্যমানতার অবসান’ হিসেবে অভিহিত করেছে। দলটি মনে করে, এতদিন নির্বাচন ঘিরে যে অনিশ্চয়তা ছিল, তা এখন অনেকটাই কেটে গেছে। যদিও বিএনপি এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানায়নি, তবে এই ঘোষণার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমীকরণে যে পরিবর্তন এসেছে, তা তারা স্পষ্টভাবেই স্বীকার করছে।
জামায়াতের অবস্থান: আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া আসছে
ঘোষণার বিষয়ে বুধবার আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি। দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা এই ঘোষণা নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং একটি বিবৃতি দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
গণতন্ত্র মঞ্চ ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা এবং বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক একে ‘স্বাগতযোগ্য’ পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, “নির্বাচনের জন্য প্রধান উপদেষ্টা সুনির্দিষ্টভাবে যে ঘোষণা দিয়েছেন, সেটা অবশ্যই ইতিবাচক। এতদিন রাজনীতিতে দ্বিধা, অবিশ্বাস, সন্দেহ ছিল, এই ঘোষণার মাধ্যমে তার অবসান হবে।” তিনি আরও বলেন, এখন সরকার পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনের প্রতি একটি আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠানো উচিত, যাতে কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করতে পারে।
গণসংহতি আন্দোলন: গ্রহণযোগ্য নির্বাচন জরুরি
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল এক বিবৃতিতে বলেন, “বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অত্যন্ত জরুরি। প্রধান উপদেষ্টার এই সময়সূচি ঘোষণা জনজীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে বলে আমরা মনে করি।” তারা আরও বলেন, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে সরকারকে সকল দলের জন্য সমান সুযোগ এবং আস্থার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
এবি পার্টি: দৃশ্যমান বিচার এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি
আবুল কালাম আজাদ নেতৃত্বাধীন এবি পার্টি ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে বলেছে, “একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পূর্বশর্ত হলো—নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা এবং দৃশ্যমান বিচার নিশ্চিত করা। সেইসঙ্গে জুলাই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচন হওয়া উচিত।” দলটির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, “এই ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশন যেন সময়মতো প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে পারে, সেই দিকটিও সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।”
ইসলামি গণতান্ত্রিক পার্টি: উন্মুখ জনগণ
দলটির চেয়ারম্যান এমএ আউয়াল বলেন, “দেশের মানুষ নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণা তাদের সেই আশা পূরণের পথে একটি বড় পদক্ষেপ।” তিনি আশা প্রকাশ করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে অনিশ্চয়তা ও দোটানা ছিল, তার অবসান হবে।
সিপিবি: নির্বাচন ডিসেম্বরেও সম্ভব
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যকে ‘নির্বাচন নিয়ে একধাপ অগ্রগতি’ হিসেবে দেখছেন। তবে তিনি মনে করেন, “এখনো ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব। প্রধান উপদেষ্টার উচিত ছিল এই বিষয়টি সরাসরি নির্বাচন কমিশনকে জানানো।”
খেলাফত মজলিস: প্রক্রিয়াগত ক্ষোভ
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক বলেন, “আমরা শুরু থেকেই জানতাম ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে, তিনি আগেও এমন আভাস দিয়েছিলেন। তবে যেভাবে ঘোষণা করা হলো, তার প্রক্রিয়া নিয়ে কিছু রাজনৈতিক দলের ক্ষোভ রয়েছে, সেটাও বিবেচনায় নেয়া দরকার।”
এনডিএমের আনন্দ মিছিল
নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণার পর জাতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম) এই ঘোষণাকে উদযাপন করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির উদ্যোগে বুধবার বিকেল ৩টায় মালিবাগ মহানগর কার্যালয় থেকে প্রেসক্লাব পর্যন্ত একটি ‘আনন্দ মিছিল’ অনুষ্ঠিত হবে। এনডিএমের দফতর সম্পাদক জাবেদুর রহমান জনি এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
ভাসানী জনশক্তি পার্টি: ধন্যবাদ ও প্রত্যাশা
ভাসানী জনশক্তি পার্টির চেয়ারম্যান শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার প্রশংসা করে বলেন, “এটি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। আমরা আশা করি, এই নির্বাচনের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক নির্বাচন হবে, যেখানে সব দল সমান সুযোগ পাবে।”
আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, দোদুল্যমানতা এবং দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সুনির্দিষ্ট সময় ঘোষণা একটি বড় অগ্রগতি হিসেবে দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়ায় বোঝা যাচ্ছে, নির্বাচন নিয়ে তারা এখন অনেকটাই মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রস্তুত। তবে নির্বাচনী প্রক্রিয়া কতটা নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য এবং প্রতিযোগিতাপূর্ণ হবে—তা নির্ভর করছে সরকারের সদিচ্ছা, নির্বাচন কমিশনের কার্যকারিতা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিকতার ওপর।
বাংলাবার্তা/এমএইচ