
ছবি: সংগৃহীত
গাজা ভূখণ্ড পুরোপুরি দখল করা হবে কিনা, সে সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণভাবে ইসরাইলের ওপর নির্ভর করছে বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইসরাইলের সামরিক অভিযান এবং প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সর্বশেষ ঘোষণার প্রেক্ষিতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে ট্রাম্প বলেন, তিনি গাজার মানবিক সংকট, বিশেষ করে খাদ্য সমস্যার দিকেই বেশি মনোযোগ দিতে চান।
বুধবার (৬ আগস্ট) মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ট্রাম্পের এ মন্তব্য উঠে আসে। আল জাজিরা জানিয়েছে, মঙ্গলবার ট্রাম্পকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, যদি ইসরাইল পুরো গাজা দখলের উদ্যোগ নেয়, তবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে তাতে কোনো হস্তক্ষেপ করবেন কি না?
প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, “আমি গাজার মানুষজনের খাদ্য নিরাপত্তার দিকেই মনোযোগ দিতে চাই। তারা কীভাবে খাবে, কোথায় থাকবে—এটাই গুরুত্বপূর্ণ। বাকি বিষয়গুলোতে আমি আপাতত মন্তব্য করতে চাই না। সবকিছু এখন ইসরাইলের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে।”
মঙ্গলবার ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা দেন, গাজা ভূখণ্ডকে পুরোপুরি দখলে নেওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবেন তারা। এ ঘোষণার পরপরই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। বিশেষ করে গাজা উপত্যকায় বন্দি থাকা ইসরাইলি নাগরিকদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিয়েই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকেই।
জাতিসংঘের শীর্ষ কর্মকর্তা মিরোস্লাভ জেনকা এই প্রসঙ্গে নিরাপত্তা পরিষদকে বলেন, “গাজা পুরোপুরি দখলের সিদ্ধান্তের পরিণতি হবে ভয়াবহ। আন্তর্জাতিক আইন এই বিষয়ে একেবারেই স্পষ্ট—গাজা হলো একটি ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেখানে সামরিক দখলদারিত্ব আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন।”
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরাইলের সামরিক অভিযানে গাজার বেশিরভাগ অঞ্চল ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। লাখ লাখ ফিলিস্তিনি তাদের ঘরবাড়ি থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত হয়েছেন। গত এক বছরে গাজার অন্তত ৮৬ শতাংশ ভূখণ্ডকে ইসরাইল সামরিকীকৃত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে। ফলে সাধারণ মানুষের চলাচল, খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ, শিক্ষার সুযোগ এমনকি জরুরি চিকিৎসাসেবাও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মহল ইসরাইলের দখল পরিকল্পনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত সরাসরি কোনো বিরোধিতা করেনি। বরং ইসরাইলের পাশে থাকার বার্তা দিয়ে যাচ্ছে বারবার। আল জাজিরা জানিয়েছে, ২০২৩ সাল থেকে শুরু হওয়া হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে সামরিক সহায়তা দেয়ার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়িয়েছে। এই সহায়তা কেবল অস্ত্র বা গোলাবারুদে সীমাবদ্ধ নয়, বরং কৌশলগত ও গোয়েন্দা সহায়তাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে গাজা উপত্যকার বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘বাসযোগ্যতার সীমা ছাড়ানো’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। জরুরি খাদ্য সহায়তার গাড়ি প্রবেশে বাধা, সীমান্ত অবরোধ, পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধসহ বিভিন্ন উপায়ে গাজা নগরবাসীকে প্রতিনিয়ত বিপর্যয়ের মুখে ফেলা হচ্ছে।
৪ আগস্ট উত্তর গাজায় খাবার ও ত্রাণ সংগ্রহ করতে আসা একটি ট্রাককে ঘিরে সংঘটিত ঘটনায় কয়েক ডজন ফিলিস্তিনি নিহত হন। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। নিহতদের জন্য শোক প্রকাশ করতে দেখা গেছে স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের, যারা দিনের পর দিন ক্ষুধা ও মৃত্যুর দ্বন্দ্বে দিন পার করছেন।
এদিকে আল আকসা মসজিদে ইসরাইলি বাহিনীর সাম্প্রতিক অভিযানেরও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া রয়েছে। পাকিস্তান সরকার এই ঘটনাকে ‘নির্লজ্জ কর্মকাণ্ড’ বলে নিন্দা জানিয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়, “পবিত্র ইসলামি স্থাপনায় এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির যেকোনো প্রচেষ্টার জন্য সরাসরি হুমকি।”
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ট্রাম্পের এই অবস্থান ভবিষ্যৎ মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির দিক নির্দেশ করতে পারে। যদিও বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসন কিছুটা মানবিক সহায়তা বাড়ানোর কথা বলেছে, তবে সামগ্রিকভাবে ওয়াশিংটনের ভূমিকা এখনো ইসরাইলপন্থী বলেই প্রতীয়মান।
এদিকে ফিলিস্তিনিদের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, গাজার পূর্ণ দখল আন্তর্জাতিক আইনের সরাসরি লঙ্ঘন এবং এটি কেবল যুদ্ধাপরাধ নয়, বরং জাতিগত নির্মূলেরও এক ভয়ংকর রূপ।
গাজা এখন একটি মানবিক বিপর্যয়ের চূড়ান্ত সীমায় দাঁড়িয়ে আছে। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে নিরপেক্ষ ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে গাজা উপত্যকার সাধারণ মানুষ অন্তত বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারটুকু ফিরে পায়। তবে ট্রাম্পের মন্তব্য ও নেতানিয়াহুর ঘোষণায় যে বার্তা স্পষ্ট তা হলো—গাজার নিয়তি এখনো নির্ধারিত হচ্ছে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে নয়, বরং একতরফা সামরিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ