
ছবি: সংগৃহীত
গাজার জনপদে আজ আর যুদ্ধ নয়, নিছক বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ। প্রতিদিনের জীবনের সংগ্রামে সবচেয়ে ভয়াবহ অস্ত্র হয়ে উঠেছে অনাহার। দুর্ভিক্ষের বাস্তবতায় পর্যবসিত হওয়া গাজায় আজ একবেলা খাবারের জন্য অপেক্ষা করে প্রাণ যাচ্ছে শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত। অথচ, ত্রাণ–সহায়তা রয়েছে মাত্র কিলোমিটারের দূরত্বে—সীমান্তে দাঁড়িয়ে আছে ২২ হাজার ত্রাণভর্তি ট্রাক, প্রবেশের কোনো অনুমতি নেই।
জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী এবং সাংবাদিকদের তথ্য অনুযায়ী, গাজার বর্তমান পরিস্থিতি এক কথায় অমানবিক বিপর্যয়। আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘আলজাজিরা’, ‘আনাদোলু’, ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ এবং জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা UNRWA—সবাই একসুরে বলছে, গাজার প্রতিদিনের বাস্তবতা এখন বারবার বাস্তুচ্যুতি, ক্ষুধা, আতঙ্ক এবং মৃত্যু।
মিসর ও জর্ডান সীমান্তে ২২ হাজার ত্রাণবাহী ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে দিনের পর দিন। খাদ্য, পানি, ওষুধ, শিশুখাদ্য, জীবনরক্ষাকারী পণ্য—সবকিছু নিয়েই তারা অপেক্ষায়। অথচ ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ এগুলোর মধ্যে মাত্র কিছু ট্রাককে ঢুকতে দিচ্ছে। গত শুক্রবার ঢুকেছে মাত্র ৭৩টি ত্রাণবাহী ট্রাক, যেখানে দৈনিক প্রয়োজন অন্তত ৬০০ ট্রাক।
জাতিসংঘের তথ্যে বলা হয়েছে, গাজার প্রতি তিনজনের দুজন এখন দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন। প্রতিদিন কেউ না কেউ না খেয়ে মারা যাচ্ছে। গতকাল সোমবারও অনাহারে মৃত্যু হয়েছে আরও ৫ জন ফিলিস্তিনির, গত কয়েক সপ্তাহে এই সংখ্যা ১৮০ ছাড়িয়েছে, যার মধ্যে ৯৩ জন শিশু।
UNRWA-র কর্মী মানার জানান, “আমরা প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠি ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায়। নিরাপদ আশ্রয় নেই। পানি নেই। খাবার নেই। আতঙ্ক, ক্ষুধা, বোমা—সব মিলে অসহনীয় জীবন।” সেভ দ্য চিলড্রেনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, “এটা কোনো সাধারণ সংকট নয়, এটা পরিকল্পিত দুর্ভিক্ষ।”
গাজা যুদ্ধের আগে যেসব শিশুরা ছিল স্বাভাবিক স্বাস্থ্যগত অবস্থায়, আজ তারা মুমূর্ষু। উত্তর গাজার এক স্কুলকে আশ্রয়কেন্দ্রে রূপান্তর করে সেখানে বাস করছেন বাস্তুচ্যুত সামাহ মাতার। তার দুই শিশু ইউসুফ ও আমির—দুজনেই আজ অপুষ্টির শিকার। ইউসুফের ওজন ১৪ কেজি থেকে ৯ কেজিতে নেমেছে। চার বছর বয়সী আমির, যার সেরিব্রাল পালসি আছে, তার ওজন কমে গেছে ৬ কেজিতে।
সামাহ বলেন, “এই শিশুদের বিশেষ খাদ্য দরকার। কিন্তু ডায়াপার নেই, ফর্মুলা নেই, চিনি পর্যন্ত নেই। আমি তাদের জন্য সামান্য ময়দাও খুঁজে পাচ্ছি না।”
গতকাল ইসরায়েলি হামলায় আরও ৯৪ জন নিহত হয়েছেন, আহত ৪৩৯ জন। শুধু গোলাবর্ষণ নয়, ত্রাণ নিতে আসা ২৯ জন নিরীহ মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন, যারা ক্ষুধার্ত ছিলেন। এভাবে প্রতিদিন মৃতের সংখ্যা বাড়ছে।
অক্টোবর ২০২৩ থেকে শুরু হওয়া এই আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত গাজায় নিহতের সংখ্যা ৬০ হাজার ৯৩৩। আহত হয়েছেন দেড় লাখের বেশি মানুষ।
এই মানবিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে এবার আওয়াজ তুলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট কংগ্রেস সদস্যদের একটি বড় অংশ। প্রতিনিধি পরিষদের ক্যালিফোর্নিয়ার আইনপ্রণেতা রো খান্না সহ বহু প্রভাবশালী নেতা স্বাক্ষর করেছেন একটি চিঠিতে, যেখানে স্পষ্টভাবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে।
এক্সিওসের প্রতিবেদন অনুসারে, এই দাবি মার্কিন কংগ্রেসে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। একই দাবিতে ইতোমধ্যে ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও কানাডার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে।
বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে যুদ্ধবাজ রাজনীতি ও অস্ত্রের দাপট, অন্যদিকে ক্ষুধার্ত শিশুদের কান্না, ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া মানুষের লাশ, আর আশায় অপেক্ষায় থাকা ২২ হাজার ত্রাণবাহী ট্রাক।
ইসরায়েলের এই নিষেধাজ্ঞা কোনো যুদ্ধের অনিবার্য পরিণতি নয়—বরং এটি এক সচেতন ও কৌশলগত মানবিক অবরোধ, যা মানবাধিকারের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অপরাধ বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
গাজায় জীবন এখন শুধুই সময়ের সঙ্গে লড়াই। শিশুরা আজ কেবল বোমার ভয়েই আতঙ্কিত নয়, তাদের কাছে খাবারের অনুপস্থিতি আরও বড় আতঙ্ক। বাঁচার জন্য ত্রাণ অপেক্ষা করছে সীমান্তে, কিন্তু মৃত্যুর ছায়া তাদের ছায়া হয়ে গেছে। বিশ্ব কি এখনো চুপ করে থাকবে?
বাংলাবার্তা/এমএইচ