
ছবি: সংগৃহীত
অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বাহিনীর নির্বিচার হামলায় প্রাণ হারানো ফিলিস্তিনির সংখ্যা প্রতিদিনই আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। সর্বশেষ রোববার (৩ আগস্ট) একদিনেই অন্তত ১১৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন আরও অন্তত ৮৬৬ জন। এই একদিনের রক্তাক্ত পরিসংখ্যানই কেবল নয়, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরাইলি সামরিক আগ্রাসনের পর থেকে মোট নিহতের সংখ্যা ৬০ হাজার ৮৩৯ জনে পৌঁছেছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে তুর্কি বার্তা সংস্থা আনাদোলু। তারা জানায়, ইসরাইলি বাহিনীর টানা বিমান, স্থল ও গোলাবর্ষণ চালানো হামলায় পুরো গাজা উপত্যকা পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে।
ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় বিভিন্ন হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্রে ১১৯টি মৃতদেহ আনা হয়েছে। আহত হয়েছেন ৮৬৬ জন, যাদের অনেকেই আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন। ফলে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তবে মন্ত্রণালয় আরও উদ্বেগজনক তথ্য দিয়ে জানায়, বহু হতাহত এখনো উদ্ধারকারীদের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া অনেক মৃতদেহ এখনও শনাক্ত বা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। একইভাবে রাস্তায় গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকা বহু হতাহতকে উদ্ধার করতে গিয়েও প্রাণ হারাচ্ছেন উদ্ধারকর্মীরা।
গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় এখন পর্যন্ত মোট আহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৯ হাজার ৫৮৮ জনে।
ইসরাইলি বাহিনীর সর্বনাশা আগ্রাসন শুধু সামরিক হামলাতেই সীমাবদ্ধ নয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রাণ হারানো ফিলিস্তিনির সংখ্যাও রীতিমতো উদ্বেগজনক মাত্রা ছাড়িয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত মানবিক সহায়তা নিতে গিয়ে ইসরাইলি বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন অন্তত ১ হাজার ৪৮৭ জন ফিলিস্তিনি। গত ২৭ মে থেকে ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১০ হাজার ৫৭৮ জন।
শুধু গত ২৪ ঘণ্টায়ই মানবিক সহায়তা নিতে গিয়ে নিহত হয়েছেন ৬৫ জন এবং আহত হয়েছেন ৫১১ জনেরও বেশি মানুষ।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর, ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের যোদ্ধারা ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলে অতর্কিত হামলা চালায়। ওই হামলায় অন্তত ১ হাজার ২০০ জন ইসরাইলি নিহত হন এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়।
এর জবাবে ইসরাইল ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করে গাজা উপত্যকায়, যা একের পর এক বেসামরিক স্থাপনা, হাসপাতাল, স্কুল ও শরণার্থী শিবিরকে নিশানা বানাতে থাকে। নারী, শিশু ও বৃদ্ধ—কেউই রক্ষা পাননি এই হামলা থেকে।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার ১৫ মাস পর যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি মধ্যস্থতাকারী দেশের চাপে গত ১৯ জানুয়ারি একপাক্ষিক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে ইসরাইল। তবে এ যুদ্ধবিরতি বেশিদিন টেকেনি। গত ১৮ মার্চ থেকে আবারও পুরোদমে হামলা শুরু করে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (IDF)। পুনরায় শুরু হওয়া হামলায় এ পর্যন্ত ৯ হাজার ৩৫০ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন আরও অন্তত ৩৭ হাজার ৫৪৭ জন।
গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর চলমান আগ্রাসন শুধু যুদ্ধ নয়, আন্তর্জাতিকভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) ইতোমধ্যেই ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও দেশটির সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে।
এছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার অভিযোগের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (ICJ) ইসরাইলের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা, জাতিসংঘের বিশেষ দূত ও রেড ক্রস ইতোমধ্যেই গাজার পরিস্থিতিকে ‘বাসযোগ্যতার সীমা ছাড়ানো মানবিক বিপর্যয়’ বলে আখ্যায়িত করেছে। খাবার, ওষুধ, পানি এবং আশ্রয়ের মারাত্মক সংকটে ভুগছে গাজার প্রায় ২২ লাখ মানুষ।
রাস্তায় ময়লা, ধ্বংসস্তূপ আর রক্তাক্ত মৃতদেহের পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে ক্ষুধার জ্বালায় খাদ্যের সন্ধানে ছোটাছুটি করা শিশু ও নারীদের করুণ দৃশ্য।
বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী মানুষ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো বারবার যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানালেও ইসরাইলি আগ্রাসন থেমে নেই। বরং প্রতিদিনই মৃতের সংখ্যা বাড়ছে, ধ্বংস হচ্ছে নতুন করে গড়ে তোলা আশ্রয়, হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
এই মৃত্যুর মিছিল থামাতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সুস্পষ্ট অবস্থান গ্রহণের সময় এখনই। নইলে ইতিহাসে এ এক অবিস্মরণীয় নৃশংসতার অধ্যায় হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে গাজা গণহত্যা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ