
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেছেন, এখন সময় এসেছে আইন তৈরি করে রেভিনিউ আনার নয়, বরং বিদ্যমান আইনকে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করে অর্থনৈতিক রাজস্ব বৃদ্ধির। তিনি বলেন, কাস্টমস ও আয়কর আইন থাকলেও এগুলো দিয়ে আর অতিরিক্ত রেভিনিউ আনা সম্ভব নয়; বরং আইন করলে রেভিনিউ কমানোর ঝুঁকি বেশি থাকে। তাই এনফোর্সমেন্ট বা আইন প্রয়োগের মাধ্যমে রেভিনিউ সংগ্রহের ওপর জোর দিতে হবে।
সোমবার (৪ আগস্ট) এনবিআরের আগারগাঁওয়ে মাল্টিপারপাস হল রুমে আয়োজিত সেমিনার ও ২০২৫-২৬ করবর্ষের ই-রিটার্ন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দীন আহমেদ।
চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, প্রতি বছর যখন বাজেট তৈরি করা হয়, তখন উচ্চাকাঙ্ক্ষী টার্গেট নির্ধারণ করা হয়। টার্গেট পূরণের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হয়, তবে সবসময় তা অর্জন করা সম্ভব হয় না। আগামী দিনে এনবিআরের অপারেশনাল দক্ষতা বাড়ানো দরকার। বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ১৭ লাখ ই-টিআইএনধারী রয়েছেন, যাদের মধ্যে অনেকেই রিটার্ন দেন না বা কর ফাঁকি দেন। এনবিআর তাদেরকে করদানে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ভ্যাট কালেকশনে বড় ধরনের অসঙ্গতি রয়েছে। অনেক ব্যবসায়ী ভ্যাট কালেক্ট করে এনবিআরকে দেয় না। এমন ব্যবসায়ীদের সিস্টেমে নিয়ে আসা এবং করদাতাদের মধ্যে কমপ্লায়েন্স বৃদ্ধি করাই এনবিআরের মূল লক্ষ্য।
বিদেশ থেকে দেশে আমদানি হওয়া আইফোনের প্রায় ৯০ শতাংশই লাগেজ পাটির মাধ্যমে প্রবেশ করে, যার ফলে সরকার কোনো রেভিনিউ পাচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে চেয়ারম্যান জানান, এই বিষয়টি নিয়ে আইসিটি মন্ত্রণালয় ও বিটিআরসির সঙ্গে আলোচনা দরকার। দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রকল্প চলছে, তবে শেষ হচ্ছে না। তিনি বলেন, “বাংলাদেশে ম্যানুফ্যাকচারিং হবে বা আইফোন আমদানি হলে ডিউটি দিতে হবে। অবৈধ ফোন কানেক্ট হলে ব্যবহারকারীরা ফোন ব্যবহার করতে পারবে না—সেক্ষেত্রে লাগেজ পাটিতে ফোন আনার প্রবণতাও কমে যাবে।”
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ভ্যাট অধ্যাদেশ জারি করার পর টোব্যাকো থেকে বড় পরিমাণ রেভিনিউ আদায়ের প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু বছর শেষে দেখা গেছে, ট্যাক্স রেট ও দাম বেড়েছে, তবুও রেভিনিউ বাড়েনি। এর পেছনে রয়েছে প্রচুর অবৈধ সিগারেট আমদানি এবং দেশীয় অবৈধ সিগারেট উৎপাদন। এনবিআর এই অবৈধ সিগারেট বাজারজাতকরণের বিরুদ্ধে যথেষ্ট কার্যকর এনফোর্সমেন্ট করতে পারেনি বলে স্বীকার করেন চেয়ারম্যান।
তিনি বলেন, “আমাদের প্রত্যাশা ছিল অতিরিক্ত ১০ হাজার কোটি টাকা রেভিনিউ আসবে টোব্যাকো থেকে, কিন্তু তা হয়নি। এখানে প্রচুর পরিমাণ অবৈধ সিগারেট রয়েছে, ভোক্তারা বিদেশি সিগারেট ব্যবহার করছে, যা সরকারের কাছে ট্যাক্স ছাড়াই আসে।” তিনি আরও জানান, এনবিআর কাস্টম হাউসে নিয়মিত বড় অঙ্কের অবৈধ সিগারেট আটক করছে এবং মাঝে মাঝে অবৈধ ফ্যাক্টরিগুলোর ওপর অভিযান চালানো হচ্ছে, তবে এই অভিযান আরও জোরালো করার প্রয়োজন রয়েছে।
চেয়ারম্যান বলেন, ২০২১ সাল থেকে দেশে বন্ডেড ওয়্যারহাউজ ব্যবস্থাপনা চালু আছে, যেখানে সবচেয়ে বেশি অপব্যবহার হয়। বন্ডেড সুবিধা ব্যবহারে অনিয়ম বাড়লে সরকার বিপুল পরিমাণ রেভিনিউ হারায়। তিনি বলেন, “রেভিনিউ আদায় করতে হলে শুধুমাত্র নীতি বা আইন নয়, অপারেশনাল দক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন। যারা বন্ডের সুবিধা নিয়ে কর ফাঁকি দিচ্ছে, তাদেরকে চিহ্নিত করে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।”
চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, এনবিআর এর ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনায় রয়েছে:
-
করদাতাদের মধ্যে কমপ্লায়েন্স বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া,
-
অবৈধ আমদানি ও সিগারেটের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া,
-
বন্ডেড সুবিধার অপব্যবহার বন্ধে নজরদারি জোরদার করা,
-
আইফোনসহ অন্যান্য অবৈধ পণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ,
-
কর সংগ্রহের জন্য ডিজিটাল ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন,
-
এবং সর্বোপরি, আইন প্রয়োগের মাধ্যমে রেভিনিউ সংগ্রহে জোর দেওয়া।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের এ বক্তব্য স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, ভবিষ্যতে রেভিনিউ সংগ্রহের ক্ষেত্রে আইন প্রণয়ন নয়, আইন প্রয়োগের জোর দিতে হবে। আইন থাকলেও যদি তা কার্যকরভাবে প্রয়োগ না করা হয়, তবে কর সংগ্রহে কাঙ্ক্ষিত উন্নতি সম্ভব নয়। তাই এনবিআর এর মূখ্য লক্ষ্য হলো কার্যকর এনফোর্সমেন্ট এবং অপারেশনাল দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধি করা।
এই নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল জোগাড় হবে।
বাংলাবার্তা/এসজে