
ছবি: সংগৃহীত
ভারতীয় রপ্তানিপণ্যের ওপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষিত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ নিয়ে অবশেষে প্রকাশ্যে মুখ খুলেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এটি ট্রাম্প প্রশাসনের একটি কঠোর পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ শুল্কভার এখন ভারতের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হলো। শুধু তাই নয়, রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ জ্বালানি বাণিজ্যকে কেন্দ্র করেও ওয়াশিংটন আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছে।
এই জটিল ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে শনিবার (২ আগস্ট) উত্তরপ্রদেশের বারাণসীতে নিজের নির্বাচনী এলাকায় আয়োজিত এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন মোদি। সেখান থেকেই তিনি প্রথমবারের মতো ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ এবং বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
নরেন্দ্র মোদি বলেন, “আজ বিশ্ব অর্থনীতি নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তার আবহ বিরাজ করছে। প্রতিটি দেশই এখন নিজের স্বার্থরক্ষায় মরিয়া হয়ে উঠেছে। ভারতও কোনো ব্যতিক্রম নয়। আমরাও আমাদের অর্থনৈতিক স্বার্থকে সর্বাগ্রে রাখতে বাধ্য।”
তিনি বলেন, “ভারত দ্রুত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হতে চলেছে। এই সময়ে আমাদের অর্থনীতিকে স্বনির্ভর, স্থিতিশীল ও টেকসই করার লক্ষ্যে দেশের কৃষক, শ্রমিক, ছোট-বড় সব শিল্প, বিশেষ করে আমাদের যুব সমাজের কর্মসংস্থানের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।”
মোদি এ সময় সরাসরি দেশবাসীর উদ্দেশে বলেন, “এটা শুধু মোদি সরকারের দায়িত্ব নয়—এটা আমাদের সবার দায়িত্ব। এখন সময় এসেছে প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকের জন্য একটি অঙ্গীকার নেওয়ার—আমরা এমন সব পণ্য কিনব, যা আমাদের দেশের মাটি, মানুষের ঘাম, এবং শ্রমে তৈরি। এই দেশীয় পণ্যের প্রতি আমাদের ভালোবাসাই হবে প্রকৃত দেশসেবা।”
‘মেইক ইন ইন্ডিয়া’ এবং ‘ভোকাল ফর লোকাল’ কর্মসূচির প্রসারে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ চেয়ে তিনি বলেন, “আজ থেকে আপনার যেকোনো কেনাকাটায় সিদ্ধান্ত নিন—দেশীয় পণ্যই কিনবেন। একজন দোকানদার, ব্যবসায়ী, কিংবা বড় উদ্যোক্তা—আপনি যেই হোন না কেন, আপনার দোকানে দেশীয় পণ্যের জন্য জায়গা রাখুন। যখন বিশ্ব অনিশ্চয়তার মাঝে ডুবছে, তখন আমাদের দৃঢ় সংকল্পই হতে পারে ভারতের ভবিষ্যতের ভিত্তি।”
মোদি বলেন, “এই সংকল্পই হবে মহাত্মা গান্ধীর প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভারতের প্রতি দায়বদ্ধতার বাস্তব প্রকাশ। যদি আমরা সত্যিই একটি বিকশিত ভারত দেখতে চাই, তবে সেটি সম্ভব হবে শুধু সম্মিলিত প্রচেষ্টায়।”
এর আগে গত বুধবার (৩১ জুলাই) হোয়াইট হাউজ থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা দেন, “ভারতীয় রপ্তানিপণ্যে এখন থেকে ২৫ শতাংশ শুল্ক বসানো হবে।” একইসঙ্গে তিনি অভিযোগ করেন, “ভারত ও রাশিয়া—এই দুটি দেশই বর্তমানে ‘মৃত অর্থনীতি’র দেশে পরিণত হয়েছে, যারা যুক্তরাষ্ট্রকে অসৎ প্রতিযোগিতার মধ্যে ফেলছে।”
ট্রাম্প প্রশাসন আরও হুঁশিয়ারি দিয়েছে, যদি ভারত ভবিষ্যতেও রাশিয়া থেকে তেল, গ্যাস ও অন্যান্য জ্বালানি আমদানি অব্যাহত রাখে, তাহলে আরও কঠোর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।
এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গয়াল সংসদে বলেন, “আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্ক মূল্যায়ন করছি। বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা চলছে। আমরা পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যালোচনা করছি।”
তিনি আরও বলেন, “সরকার প্রতিটি খাত—কৃষি, শিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ, রপ্তানি, শ্রমিক কল্যাণ—সবদিক বিবেচনায় নিয়ে পদক্ষেপ নেবে। আমাদের উদ্দেশ্য হলো জাতীয় স্বার্থের রক্ষা এবং ভারসাম্যপূর্ণ বাণিজ্যিক অগ্রগতি।”
বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্প প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র শুল্ক বাড়ানো নয়, বরং এক প্রকার চাপ প্রয়োগের কৌশল। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে ভারত যেন তাদের সামরিক ও জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থায় আরও ঘনিষ্ঠ হয় এবং রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা কমায়।
তবে মোদির বক্তব্য স্পষ্ট করে দেয় যে, ভারত আপাতত তার নিজস্ব স্বার্থে চলবে এবং আন্তর্জাতিক চাপের মুখেও দেশীয় শিল্প ও কৃষিকে সুরক্ষা দিতে প্রস্তুত।
ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের প্রেক্ষাপটে ভারতের জবাব যে ‘প্রতিশোধমূলক শুল্ক’ নয় বরং দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরতার মাধ্যমে নিজেদের অর্থনৈতিক কাঠামো শক্তিশালী করা, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই।
মোদি তার বক্তব্যে যেভাবে ‘ভোকাল ফর লোকাল’–এর মন্ত্র উচ্চারণ করেছেন, তাতে বোঝা যাচ্ছে সরকার এখন শুধু নীতিগত নয়, সামাজিক স্তরেও দেশীয় পণ্যের গ্রহণযোগ্যতা ও সচেতনতা বাড়াতে চায়।
এই মুহূর্তে ভারতের সামনে দুটি চ্যালেঞ্জ—একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক চাপ, অন্যদিকে রাশিয়ার সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্ক রক্ষা। আর এই সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রেখেই দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি।
ট্রাম্পের শুল্ক চাপের প্রতিক্রিয়ায় মোদির এই প্রকাশ্য বক্তব্য তাই কেবল প্রতিক্রিয়া নয়—এটি এক ধরনের নীতিগত ঘোষণা, যা ভারতকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও কূটনীতির নতুন বাস্তবতায় প্রস্তুত রাখার বার্তা দিচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ