
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের চলমান বাণিজ্য আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা একটি ‘নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট’ বা গোপন চুক্তি অচিরেই জনসমক্ষে আনা হবে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। তবে এই প্রকাশ কেবল যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতির সাপেক্ষে এবং যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে হবে বলে স্পষ্ট করেছেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শেখ বশিরউদ্দীন এসব কথা বলেন। স্থানীয় সময় শুক্রবার এই সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয় এবং পরদিন প্রেস মিনিস্টার গোলাম মোর্তোজা তা তার নিজস্ব ফেসবুক পেজে তুলে ধরেন। সাক্ষাৎকারের একদিন আগেই, বৃহস্পতিবার, যুক্তরাষ্ট্র ট্রাম্প প্রশাসনের আরোপিত পালটা শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনে—যা চুক্তিটি ঘিরে আলোচনার গতিপথে নতুন মাত্রা যোগ করে।
গোপন চুক্তি নিয়ে দেশের ভেতরে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা রয়েছে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, এমন চুক্তিতে দেশের স্বার্থবিরোধী বা ভূরাজনৈতিক নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয় থাকতে পারে। এই বিষয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা সরাসরি বলেন, “চুক্তির মাধ্যমে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির বা বাণিজ্য সক্ষমতার ক্ষতি হয়—এমন কিছু চুক্তিতে আমরা কখনোই এগোব না।”
তিনি আরও বলেন, “চুক্তির সবকিছু আমরা যাচাই-বাছাই করেছি। কিছু বিষয়ে ঝুঁকি থাকলেও আমরা আলোচনার মাধ্যমে তা থেকে বেরিয়ে এসেছি। নন-ডিসক্লোজার থাকা মানেই সব কিছু দেশের বিরুদ্ধে—এমন ভাবার কারণ নেই।”
শেখ বশিরউদ্দীন চুক্তির গোপনীয়তা প্রসঙ্গে একটি তুলনামূলক উদাহরণ টেনে বলেন, “শুধু আন্তর্জাতিক নয়, স্থানীয়ভাবে দুটি ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠান চুক্তি করলেও অনেক বিষয় গোপন থাকে। এটি স্বাভাবিক। এমনকি ব্যক্তিরাও সম্পত্তি হস্তান্তরের সময় গোপন সমঝোতা করে থাকেন, যাতে তৃতীয় পক্ষ এসে দাবি করতে না পারে।”
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তরের (USTR) সঙ্গে পালটা শুল্ক সংক্রান্ত আলোচনায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। তার সঙ্গে ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান ও অতিরিক্ত সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরী।
এই তিন দফা আলোচনার ফলাফল হিসেবে ট্রাম্প প্রশাসন থেকে আরোপিত ৩৫ শতাংশ পালটা শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনে যুক্তরাষ্ট্র। তবে শেখ বশিরউদ্দীনের মতে, “এই হ্রাসপ্রাপ্ত শুল্ক কতটা কার্যকর হবে তা নির্ভর করবে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের প্রস্তুতি ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতার ওপর।”
তিনি বলেন, “এখনই আত্মতুষ্ট হওয়ার সুযোগ নেই। নিজেদের প্রস্তুতি না থাকলে এই সুবিধা কাজে লাগানো কঠিন হবে।”
চুক্তির বিনিময়ে বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং কোম্পানি থেকে ২৫টি উড়োজাহাজ কেনার পরিকল্পনা নিচ্ছে বলে বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলছে। এ বিষয়ে উপদেষ্টাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি পরিষ্কারভাবে বলেন, “নেগোসিয়েশনের সময় একবারও এই বিষয়টি আলোচনায় আসেনি। বরং যুক্তরাষ্ট্রের মূল আগ্রহ ছিল তাদের কৃষিপণ্য রপ্তানিতে।”
শেখ বশিরউদ্দীন জানান, “আমার জানা মতে, বোয়িং এখন পর্যন্ত মাত্র ১২টি উড়োজাহাজ তৈরি করেছে। তারা বাংলাদেশকে ২০৩৭ সালের আগে একটি বিমানও সরবরাহ করতে পারবে না। ফলে বোয়িং বিক্রির বিষয়টি বাস্তব আলোচনায় স্থান পায়নি।”
তিনি আরও বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র একটি কৃষিপণ্য উৎপাদনকারী দেশ। তাদের উদ্দেশ্য হলো প্রতিযোগিতামূল্যে খাদ্যপণ্য রপ্তানি করে বাজার দখল করা। এতে বাংলাদেশেরও লাভ আছে—কারণ আমরা প্রতিবছর ১৫-২০ বিলিয়ন ডলারের খাদ্য আমদানি করি। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সস্তায় খাদ্য আমদানি করা গেলে বাজার স্থিতিশীল থাকবে, ভোক্তা পর্যায়ে দাম সহনীয় হবে।”
বর্তমানে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রতিবছর প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মোট বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার। এই ঘাটতি কমাতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা, গম, সয়াবিন, ভুট্টা এবং এলএনজি আমদানির পরিকল্পনার কথা জানান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, “এই খাতে আমদানি বাড়িয়ে ২ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি মেটানো গেলে তা বাংলাদেশের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ হবে।”
তিনি আরও বলেন, “এজন্য সরকারি আলোচনার পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্র সফরে এসেছে। তারাও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। এভাবে বাণিজ্যের বহুমাত্রিক সম্প্রসারণ সম্ভব।”
বোয়িং কোম্পানির কাছ থেকে ২৫টি উড়োজাহাজ কেনা নিয়ে সমালোচনা প্রসঙ্গে উপদেষ্টা বলেন, “এই সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক চুক্তির ফল নয়, বরং বাংলাদেশ বিমানের পরিচালনাগত দুর্বলতা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।”
তিনি জানান, গত বছর এক কোটি ২০ লাখ যাত্রী বিমানবন্দর ব্যবহার করলেও মাত্র ২০ লাখ যাত্রী বাংলাদেশ বিমানের সেবা নিয়েছেন। বাকি এক কোটির বেশি যাত্রীকে অন্যান্য এয়ারলাইন্সে হারিয়েছে দেশ। এই বিশাল বাজার হাতছাড়া হওয়াটাই বিমানকে একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে বড় বাধা।
তিনি বলেন, “তাই ২৫টি উড়োজাহাজ আসলে যথেষ্ট নয়, বরং আরও বেশি দরকার হবে। তবে শুধু বিমান কিনে হবে না, পরিচালনার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সেজন্য আইন ও নীতিমালায় পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা অচিরেই দৃশ্যমান হবে।”
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের নন-ডিসক্লোজার ভিত্তিক বাণিজ্য চুক্তিকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী যে প্রশ্ন উঠেছে, তার জবাবে সরকার পরিষ্কার করেছে যে জাতীয় স্বার্থের কোনো ক্ষতি হয়নি এবং হবে না। তবে পুরো প্রক্রিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতিতে প্রকাশযোগ্য হওয়ায় জনসাধারণের জিজ্ঞাসা ও উদ্বেগ একেবারে অবান্তরও নয়।
শেখ বশিরউদ্দীনের দেওয়া বক্তব্য ও যুক্তি একদিকে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করলেও, অপরদিকে এটি আবার প্রমাণ করে যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কূটনীতি কেবল অর্থনৈতিক নয়—বরং কৌশলগত, নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গেও জড়িত।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কতটা সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিতে পারে, এবং এই চুক্তির বাস্তব সুফল কতটা কাজে লাগাতে পারে—তা নির্ধারণ করবে ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও রপ্তানি সক্ষমতা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ