
ছবি: সংগৃহীত
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বাহিনীর টানা আগ্রাসনে একদিনেই প্রাণ হারিয়েছেন আরও ৯৮ জন ফিলিস্তিনি। আহত হয়েছেন এক হাজারেরও বেশি মানুষ। এই একক দিনের হিসাবেই বোঝা যায়, গাজায় মানবিক বিপর্যয় কোন মাত্রায় পৌঁছেছে। গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে চলমান ইসরাইলি আগ্রাসনে এ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজার ৪৩০ জনে। আহত হয়েছেন অন্তত ১ লাখ ৪৮ হাজার ৭২২ জন।
গাজা যুদ্ধের এ মর্মান্তিক পরিসংখ্যান শনিবার (২ আগস্ট) এক বিবৃতিতে জানায় ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এই তথ্য তুলে ধরে তুরস্কভিত্তিক সংবাদ সংস্থা আনাদোলু একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে যুদ্ধের নিষ্ঠুর বাস্তবতা এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘনের বিস্তৃত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ৯৮টি মৃতদেহ গাজার বিভিন্ন হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্রে আনা হয়েছে। পাশাপাশি আহত হয়েছেন আরও ১,০৭৯ জন মানুষ। তবে হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোর সীমিত সক্ষমতার কারণে অনেক সময় মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ সম্ভব হচ্ছে না। উদ্ধারকারীরা জানান, এখনও বহু হতাহত ব্যক্তি ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ে আছেন, যাদের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না।
গাজা উপত্যকার বিস্তীর্ণ এলাকা বর্তমানে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বহু ভবন পুরোপুরি ধসে পড়েছে, রাস্তা ও সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সাধারণ নাগরিক ও উদ্ধারকর্মীদের চলাচল কঠিন হয়ে উঠেছে। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, "উদ্ধারকারীরা বহু এলাকায় এখনও পৌঁছাতে পারেননি। ফলে হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। ধ্বংসস্তূপের নিচে কিংবা রাস্তায় আটকে থাকা অসংখ্য মানুষের জীবন এখন মৃত্যুর প্রহর গুনছে।"
ইসরাইলি আগ্রাসনের মধ্যে সবচেয়ে বেদনাদায়ক দিকগুলোর একটি হলো—খাদ্য, পানি কিংবা ওষুধ সংগ্রহ করতে গিয়েই বহু ফিলিস্তিনির মৃত্যু। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শুধু গত একদিনেই ত্রাণ নিতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ৩৯ জন এবং আহত হয়েছেন আরও ৮৪৯ জন।
এ নিয়ে গাজায় মানবিক সহায়তা নিতে গিয়ে নিহত মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪২২ জনে।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ২০২৪ সালের ২৭ মে ‘গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন’ নামে একটি বিতর্কিত উদ্যোগ চালু হওয়ার পর থেকেই আক্রান্তদের সংখ্যা আরও বেড়েছে। এই সময়ের মধ্যে আহত হয়েছেন অতিরিক্ত ১০ হাজার ৬৭ জন। এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে—যুদ্ধবিরতির প্রতিশ্রুতি কিংবা ত্রাণ সহায়তার কার্যক্রমও বাস্তবে গাজাবাসীর জীবন বাঁচাতে ব্যর্থ হচ্ছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজা উপত্যকা থেকে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের যোদ্ধারা সীমান্ত অতিক্রম করে ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলে প্রবেশ করে। হামলায় ১ হাজার ২০০ ইসরাইলি নিহত হয় এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়। এই ঘটনার পরপরই প্রতিশোধমূলক অভিযান শুরু করে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (IDF)। প্রথমে প্রতিশ্রুতি ছিল কেবল জিম্মিদের মুক্তি এবং হামাসের বিরুদ্ধে সীমিত অপারেশন চালানো হবে।
কিন্তু বাস্তবে তা পরিণত হয় পূর্ণাঙ্গ আগ্রাসনে। বিমান হামলা, স্থল অভিযান, আর্টিলারি গোলাবর্ষণ, হাসপাতাল ও স্কুলে আঘাত—সবকিছু মিলিয়ে গাজা যুদ্ধ এখন ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ মানবিক সংকট হিসেবে চিহ্নিত। যুদ্ধের প্রথম তিন মাসেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় গাজার বেশিরভাগ নাগরিক স্থাপনা।
২০২৫ সালের ১৯ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন মধ্যস্থতাকারী দেশের চাপে একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। কিন্তু সেই শান্তি স্থায়ী হয়নি। মাত্র দুই মাসের মধ্যেই, ১৮ মার্চ থেকে পুনরায় শুরু হয় আইডিএফের পূর্ণমাত্রার সামরিক অভিযান।
এই নতুন দফার অভিযানে লক্ষ্যবস্তু করা হয় গাজার দক্ষিণাঞ্চল, যেখানে হাজার হাজার অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। ফলে সহিংসতা নতুন করে ছড়িয়ে পড়ে এবং হতাহতের সংখ্যা লাফিয়ে বাড়ে।
গাজা যুদ্ধের কারণে ইসরাইল আন্তর্জাতিক পর্যায়েও চাপে পড়েছে। ২০২৪ সালের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং তার সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। এছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার দায়ের করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইসরাইলের বিরুদ্ধে ‘গণহত্যার’ অভিযোগে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতেও শুনানি চলছে।
তবে আন্তর্জাতিক আদালতের এসব উদ্যোগ সত্ত্বেও ইসরাইলি বাহিনীর গাজায় আগ্রাসন থামেনি। বরং দিনে দিনে হামলার মাত্রা আরও বেড়েছে।
প্রতিদিন গড়ে ১০০-র বেশি মানুষ নিহত হচ্ছেন। শিশুরা স্কুলে যেতে পারছে না, হাসপাতালে জায়গা নেই, ওষুধ নেই, পানি নেই—গাজা এখন কার্যত এক মৃত্যুপুরী। েসংবাদ সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো যেসব তথ্য প্রকাশ করছে, তা শুধু পরিসংখ্যান নয়—এটি এক জাতির অস্তিত্ব টিকে থাকার জন্য জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ের দলিল।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের এমন সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকার পরও বিশ্ব শক্তিগুলোর কার্যকর ভূমিকা অনুপস্থিত। এমন প্রেক্ষাপটে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আর কত প্রাণের বিনিময়ে ন্যায়ের পক্ষে কথা বলবে—এ প্রশ্ন এখন কোটি গাজার মানুষের।
বাংলাবার্তা/এমএইচ