
ছবি: সংগৃহীত
রাজনৈতিক সমাবেশ, এইচএসসি ও বিসিএস পরীক্ষার মতো একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম এক দিনে আয়োজনের ফলে রবিবার (৩ আগস্ট) সকাল থেকে রাজধানী ঢাকায় সৃষ্টি হয়েছে নজিরবিহীন যানজট। দিনের শুরু থেকেই রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়কে ধীরগতির যানবাহন, গাদাগাদি করে গণপরিবহনে ওঠা, বাসস্টপে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের দীর্ঘ সারি এবং অতিরিক্ত সময় ধরে গন্তব্যে পৌঁছাতে গিয়ে নগরবাসীর অসন্তোষ—সব মিলিয়ে শহরজুড়ে সৃষ্টি হয় অস্বস্তিকর পরিবেশ।
সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস হওয়ায় অফিসগামী মানুষের চাপ এমনিতেই বেশি থাকে। এর মধ্যে একযোগে অনুষ্ঠিত হচ্ছে উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষা এবং ৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা। অন্যদিকে ঢাকায় দুটি রাজনৈতিক দলের সমাবেশ, এক সাংস্কৃতিক উৎসব এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা রাজধানীর যানবাহন চলাচলকে করে তোলে প্রায় স্থবির।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সকাল ৮টা থেকে শুরু হয় যানজট। বিশেষ করে কারওয়ানবাজার, ফার্মগেট, শ্যামলী, মিরপুর-১০, বিজয় সরণি, রামপুরা, মৌচাক, শাহবাগ, নীলক্ষেত, পলাশী, চাঁদনী চক, গাবতলী, কলাবাগান, যাত্রাবাড়ী, সায়েন্সল্যাব, আজিমপুর ও মালিবাগ এলাকায় গাড়ির গতি ছিল অত্যন্ত ধীর। সড়কে যানবাহনের ভিড়ের কারণে শুধু ব্যক্তি গাড়ি নয়, গণপরিবহনও নির্ধারিত সময়ে চলতে পারছিল না।
সকাল ৯টার দিকে কারওয়ানবাজারে দাঁড়িয়ে রিপন নামের এক বেসরকারি চাকরিজীবী সময় সংবাদকে বলেন, “আজ তো পুরো নরক পরিস্থিতি। বাসে উঠতেই এক ঘণ্টা লেগে গেছে। তারপর ঝুলে ঝুলে এসেছি। বিশ্বরোড থেকে কারওয়ানবাজার আসতে যেখানে সাধারণত দেড় ঘণ্টা লাগে, সেখানে আজ দুই ঘণ্টারও বেশি সময় লেগেছে।”
শুধু যাত্রীরা নন, পরিবহন চালকরাও আজ ছিলেন দারুণ বিরক্ত ও অসহায়। টেকনিক্যাল সিগন্যাল থেকে শ্যামলী পর্যন্ত আসতে সময় লেগেছে ৩৫ মিনিট—এমনটি জানালেন বাসচালক শফিক। তিনি বলেন, “সাধারণ দিনে যেখানে ১০ মিনিটে যাওয়া যায়, আজ সেখানে একেকটা মোড় পার হতে ১০ মিনিটের বেশি লাগছে। জ্যামই জ্যাম।”
এ পরিস্থিতির অন্যতম কারণ হলো দুপুর থেকে শুরু হওয়া দুটি রাজনৈতিক দলের সমাবেশ। বিএনপি’র ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল এবং নতুন রাজনৈতিক মঞ্চ জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ঢাকার দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বড় সমাবেশের আয়োজন করে।
ছাত্রদল শাহবাগে ‘গণঅভ্যুত্থান, শোক ও বিজয়ের প্রথম বর্ষপূর্তি’ উপলক্ষে সমাবেশের ঘোষণা দেয়। অন্যদিকে এনসিপি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদ’ দাবিতে সমাবেশ করে এবং সারা দেশে অনুষ্ঠিত পদযাত্রা শেষে ‘জাতীয় ইশতেহার’ ঘোষণা করার কর্মসূচি নেয়।
এ দুটি সমাবেশ ঘিরে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) শনিবার রাতে এক গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে জানায়, শাহবাগ, টিএসসি, পলাশী, সায়েন্সল্যাব, নীলক্ষেত ও পল্টন–বিভিন্ন এলাকায় যানচলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হবে এবং বিকল্প রুট ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে বাস্তবে অনেকেই রুট পরিবর্তনের তথ্য জানতেন না, ফলে ভোগান্তির মাত্রা আরও বেড়ে যায়।
এই দুই রাজনৈতিক সমাবেশ ছাড়াও রাজধানীর মঞ্চ সংস্কৃতি চর্চায় পরিচিত সাইমুম শিল্পগোষ্ঠীর আয়োজন ‘৩৬ জুলাই কালচারাল ফেস্ট: জুলাই জাগরণ’ এর তৃতীয় দিনের কর্মসূচিও আজ সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত নির্ধারিত রয়েছে। জাতীয় জাদুঘরের আশপাশের এলাকায় এ উপলক্ষে লোকসমাগম বেড়েছে।
এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা সকাল ৯টা থেকে বিভিন্ন কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে গেলে তাদের সময়মতো পৌঁছানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। একই অবস্থা বিসিএস পরীক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও দেখা যায়।
মিরপুর-১৩ থেকে বেরিয়ে পলাশী যাওয়ার পথে সুমাইয়া নামে এক এইচএসসি পরীক্ষার্থী বলেন, “যদি আগেভাগে না বের হতাম, তাহলে আজ পরীক্ষা হলে পৌঁছানোই হতো না। এক জায়গায় এতটা সময় দাঁড়িয়ে ছিলাম যে, বাসের কনডাক্টরই আমাদের বলল নামতে।”
রাজধানীর গণপরিবহন ব্যবস্থায় এমনিতেই ঘাটতি রয়েছে। প্রতিদিনের ভোগান্তি যাত্রীদের নিত্য অভ্যাসে পরিণত হলেও আজকের পরিস্থিতি ছিল নজিরবিহীন। যাত্রীরা এক প্রকার বাধ্য হয়ে বাসের গেট ও জানালার গ্রিলে ঝুলে যাতায়াত করেন।
রাজধানীবাসীর অভিযোগ, এমন দিনে প্রশাসনের দায়িত্ব ছিল সমন্বয় করে সমাবেশ, পরীক্ষা ও উৎসবের সূচি নির্ধারণ করা। বিশেষ করে যেদিন বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থী রাস্তায় থাকবে, সেদিন একাধিক রাজনৈতিক কর্মসূচি ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরের সড়কে মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
সব মিলিয়ে আজকের দিনটি রাজধানীবাসীর জন্য ছিল দুঃসহ স্মৃতি। নাগরিকরা প্রশ্ন করছেন—এমন অদূরদর্শী পরিকল্পনার দায় কে নেবে? আর আগামীতে এ ধরনের সমাবেশ-পরীক্ষা একসঙ্গে হলে রাজধানী পুরোপুরি অচল হয়ে পড়বে না তো?
সরকার, রাজনৈতিক দল ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যদি সময়মতো সঠিক সমন্বয় করতে না পারে, তাহলে ভোগান্তির চক্র থেকে ঢাকা আর কখনোই বের হতে পারবে না বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিবহন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ