
ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে একের পর এক প্রকল্পের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হলেও আজও রেহাই মেলেনি শহরবাসীর। বৃষ্টি হলেই ডুবে যায় নগরের রাস্তা, ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান—আর তলিয়ে যায় সরকারের প্রতিশ্রুতির ভিত্তি। ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) এই সমস্যা সমাধানে যে মেগা প্রকল্প হাতে নেয়, তার ব্যয় ধাপে ধাপে বেড়ে এখন ১৪ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা। অথচ প্রকল্পের প্রায় ৭০ শতাংশ অর্থ খরচ হয়ে যাওয়ার পরও জলাবদ্ধতা থেকে চট্টগ্রামবাসী মুক্তি পাচ্ছে না। বরং বছরের পর বছর দুর্ভোগ শুধু বেড়েই চলেছে।
গত সোমবার (২৮ জুলাই) সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত মাত্র তিন ঘণ্টায় ৬৪ মিলিমিটার বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন এলাকা কোমরসমান পানিতে ডুবে যায়। কোথাও কোথাও বাসাবাড়ি ও দোকানেও পানি উঠে গেছে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয়, এ সময়ে নগরের রাস্তায় যানবাহন বন্ধ হয়ে গেলে মানুষ নৌকা দিয়ে চলাচল করেছে। সিটি করপোরেশন এবং উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে এই চিত্রকে "চলমান কাজের ফাঁকে সাময়িক অসুবিধা" বলা হলেও নাগরিক দুর্ভোগ ছিল চরম। হালিশহর, আগ্রাবাদ, কাতালগঞ্জ, জিইসি মোড়, তিন পোলের মাথা, চকবাজারের মতো এলাকাগুলো কার্যত অচল হয়ে পড়ে।
একইভাবে গত ৯ জুলাই সকাল ৯টা থেকে ১২টা এবং ১৮ জুন সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত সময়ে ৭০ ও ৮৯ মিলিমিটার বৃষ্টিতেও নগরী তলিয়ে যায়। বিশেষ করে জুন মাসের ভারি বৃষ্টিতে পাঁচলাইশ, বাকলিয়া, মুরাদপুর, হিজড়া খাল ঘেঁষা এলাকা এবং চকবাজার ছিল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।
চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকারের পক্ষ থেকে চারটি বড় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে চউকের ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে সবচেয়ে বেশি—৫ হাজার ৫৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। এছাড়া কর্ণফুলী নদীর তীরে রাস্তা ও জলকপাট নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৩২৮ কোটি ৫১ লাখ টাকা। চসিক পরিচালিত বাড়ইপাড়া থেকে বলিরহাট পর্যন্ত নতুন খাল খননে খরচ হয়েছে ১ হাজার ২৭০ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ব্যয় ১ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা।
সর্বমোট ৯ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ইতোমধ্যে ব্যয় হয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কিছু বৃষ্টি হলেই শহরের বিস্তীর্ণ অংশ অচল হয়ে পড়ে। চউক এখন পর্যন্ত ৩৬টি খাল সংস্কারে কাজ করছে, যার মধ্যে ২৫টির কাজ শেষ হলেও বাকি ১১টির কাজ এখনও অসম্পূর্ণ। ৬টি খালের কাজ ৯০ শতাংশের ওপরে থাকলেও হিজড়া খালের মতো গুরুত্বপূর্ণ খালের কাজ এখনো শুরুই করা যায়নি—আর্থিক সংকটের কারণ দেখিয়ে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন সম্প্রতি নগরের কাতালগঞ্জ ও কাপাসগোলা এলাকার জলাবদ্ধতা পরিদর্শনকালে বলেন, “চউক ৩৬টি খালের কাজ করছে, এর মধ্যে ২২টি শেষ হয়েছে। আরও ২০টি খালের দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে।” তিনি আশাবাদ জানিয়ে বলেন, “হিজড়া খাল ও নালার কাজ শেষ হলে জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান হবে।”
চউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নুরুল করিম বলেন, “বর্ষার কারণে কাজ করা যাচ্ছে না। আগস্টের শেষে আবার কাজ শুরু হবে। এরপর ১৬০০ কিলোমিটার নালার কাজ করতে হবে। সব কাজ শেষ হলে নগরবাসী জলাবদ্ধতা থেকে ৮০ শতাংশ রেহাই পাবে।” তিনি আরও জানান, “মোগলটুলিতে একটি স্লুইচ গেটের কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। সেটি শেষ হলে আগ্রাবাদ এলাকায় উপকার হবে। ইতোমধ্যে ১০টি পাম্প বসানো হয়েছে, যা প্রতি ঘণ্টায় ২০ কোটি লিটার পানি অপসারণ করছে। আরও দুটি পাম্প বসানো হবে।”
পরিবেশবিদ ও নদী গবেষক ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেন, “চট্টগ্রামে যে কয়টি খাল রয়েছে, সেগুলোর পানি বহনের সক্ষমতা বা স্টাডি কারও কাছে নেই। শুধু কালুরঘাট থেকে কর্ণফুলী নদীর মোহনা পর্যন্ত ২০টি ডুবন্ত চরে ময়লা জমে আছে। সেখানে কোনো পরিকল্পিত ড্রেজিং হয়নি, বরং নদীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “জলাবদ্ধতা প্রকল্প নিয়ে সবাই শুধু ব্যবসা করেছে। কেউ প্রকৃত সমাধান চায়নি। যে যখন দায়িত্ব পেয়েছে, সেই শুধু নিজ নিজ স্বার্থে কাজ করেছে। প্রকল্পে কোনও সমন্বয় নেই। যার কারণে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি বরং ভোগান্তি বাড়ছে।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. ফয়সাল হোসেন বলেন, “একটি শহরের জলাবদ্ধতা মোকাবিলার জন্য প্রযুক্তিগত সমাধানের পাশাপাশি রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার। চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে দুর্ভাগ্যজনকভাবে দুটোই অনুপস্থিত। হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে কেবল কাগুজে অগ্রগতি দেখানো হচ্ছে। মাঠে তার প্রতিফলন নেই।”
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সভাপতি এডভোকেট আ ক ম মহিউদ্দিন বলেন, “এই প্রকল্পগুলো দুর্নীতির খনি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যখনই প্রকল্প বাড়ানো হয়, তখনই অজুহাত থাকে ‘সংস্কার দরকার’। কিন্তু প্রকৃত কার্যকারিতা যাচাই করার কেউ নেই। জবাবদিহিতার অভাবে এই দুর্নীতিগুলো বছরের পর বছর চলে আসছে।”
নগরবাসীর প্রশ্ন—কেন ১৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেও এই দুর্ভোগ দূর হলো না? কেন প্রতি বছর বর্ষায় শহর তলিয়ে যায়? কেন দুর্যোগ মোকাবিলায় কোনও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না?
নগর উন্নয়ন আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং স্থপতি মোবারক হোসেন বলেন, “নগরের উন্নয়ন পরিকল্পনায় সামগ্রিকতা ও বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে বরাদ্দ কেন্দ্রিক ‘মেগা প্রকল্প’ বানানো হয়েছে। যার কারণে জনগণের টাকা অপচয় হচ্ছে, আর প্রকৃত পরিবর্তন আসছে না।”
চট্টগ্রাম নগরবাসীর জলাবদ্ধতার যন্ত্রণা নতুন নয়। কিন্তু যখন হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়—কাজ হয় অর্ধেক, ভোগান্তি হয় দ্বিগুণ—তখন প্রশ্ন ওঠে, জনগণের এই অর্থ কোথায় যাচ্ছে? একদিকে প্রকল্প শেষ হচ্ছে না, অন্যদিকে বর্ষা এলেই পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে মানুষের স্বপ্ন ও সম্ভাবনা। চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা শুধুই প্রকৌশলগত সমস্যা নয়, এটি এখন একটি গভীর প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যর্থতার প্রতীক। প্রকল্প শেষ করে, দুর্নীতি বন্ধ করে এবং বিজ্ঞানসম্মত সমাধান দিয়ে যদি এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে প্রতি বছরই নগরবাসী বৃষ্টির পানিতে ডুবতে থাকবে—আর প্রকল্পের নামে জনগণের অর্থ বয়ে যাবে অন্ধকারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ