
ছবি: সংগৃহীত
মানব জীবনের কোনো এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে হঠাৎ করেই রক্তের প্রয়োজন পড়তে পারে। তা হতে পারে দুর্ঘটনা, বড় অস্ত্রোপচার, বা কোনো জটিল রোগের চিকিৎসার সময়। এমন সময় একজন সুস্থ মানুষের রক্তদান কেবল একটি দানই নয়, বরং অন্য কারো জীবন বাঁচানোর এক মহৎ উদ্যোগ। প্রতিটি রক্তদান এক মানুষের নতুন জীবন দেয়। চিকিৎসা ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বড় ধরনের আগুনে পোড়ার রোগী, হার্ট সার্জারি কিংবা ক্যানসারের মতো গুরুতর অবস্থায় রক্তের চাহিদা অপরিসীম। এজন্য রক্তদান একটি সমাজসেবামূলক কার্যক্রম হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সুস্থ কোনো ব্যক্তির প্রতি চার মাস অন্তর রক্তদান করা যেতে পারে, নারীদের ক্ষেত্রে সাধারণত ছয় মাস অন্তর রক্তদানের পরামর্শ দেওয়া হয়। জরুরি প্রয়োজনে বা যেকোনো সময় সুস্থ ব্যক্তি রক্ত দিতে পারেন। তবে রক্তদান একটি শারীরিক প্রক্রিয়া হওয়ায় এর আগে ও পরে কিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা অত্যাবশ্যক। হেল্থ এইড হাসপাতালের ডা. আফিফ বাসার এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
দুর্ঘটনা, আগুনে পোড়া, গুরুতর আঘাত, বা বড় অস্ত্রোপচারের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে রোগীর রক্তের তীব্র প্রয়োজন হয়। হার্ট সার্জারি, ক্যানসারের চিকিৎসায় যেমন কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি, তেমনি রক্তের ঘাটতি ঘটে এমন রোগগুলোতে নিয়মিত রক্ত প্রদান জরুরি। থ্যালাসেমিয়া, অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া এবং অন্যান্য রক্তরোগে আক্রান্ত রোগীরা নিয়মিত রক্তের উপর নির্ভরশীল। প্রসবকালীন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ মায়ের জীবন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। চিকিৎসকরা রোগীর অবস্থা পরীক্ষা করে রক্তের প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণ করেন।
রক্তদান মানবিক দায়িত্ব হলেও এটি শারীরিকভাবে প্রস্তুতি প্রয়োজন। রক্তদানের আগের রাতে পর্যাপ্ত এবং শান্তিপূর্ণ ঘুম নিশ্চিত করতে হবে। কারণ ঘুমের অভাব শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রমে প্রভাব ফেলে এবং রক্তদান প্রক্রিয়ায় দুর্বলতা সৃষ্টি করতে পারে। রক্তদানের ১ থেকে ৪ ঘণ্টা আগে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা উচিত, যা লৌহসমৃদ্ধ (আয়রন-সমৃদ্ধ) হলে রক্তগঠন শক্তিশালী হয়। খালি পেটে রক্তদান করা ঠিক নয়, কারণ এতে মাথা ঘোরা, দুর্বলতা বা বমি ভাবের ঝুঁকি থাকে।
রক্তদানের পূর্বে কমপক্ষে ৫০০ মিলিলিটার (প্রায় দুই গ্লাস) পানি পান করা জরুরি, যা রক্তের ভলিউম বজায় রাখতে সাহায্য করে। শরীরে কোনো জ্বর, সর্দি-কাশি বা অন্য কোনও রোগের লক্ষণ থাকলে রক্তদান করা উচিত নয়। এছাড়া যারা অ্যান্টিবায়োটিক, ইনসুলিন, অ্যাসপিরিন বা অন্য কোনও ওষুধ নিয়েছেন, তাদের অবশ্যই রক্তদানের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে, কারণ কিছু ওষুধ রক্তদান অযোগ্য করে তোলে।
রক্তদানের অন্তত ২৪ ঘণ্টা আগে মদপান, এবং ২ থেকে ৪ ঘণ্টা আগে ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে। রক্তদাতার বয়স ১৮ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে হওয়া উচিত এবং ওজন ন্যূনতম ৪৫ কেজি (১০০ পাউন্ড) বা তার বেশি হতে হবে।
রক্তদান শেষে শরীরকে সুস্থ ও শক্তিশালী রাখতে পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। পরবর্তী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রচুর পরিমাণে পানি, ফলের রস, ডাবের পানি, লেবুর শরবত অথবা স্যুপ গ্রহণ করা উচিত, যা রক্তের প্লাজমা দ্রুত পূরণে সাহায্য করে। রক্তদানের পর ১০ থেকে ১৫ মিনিট বিশ্রাম নেওয়া জরুরি, বিশেষ করে যেই স্থানে রক্তদান করা হয়েছে, সেখানে কিছুক্ষণের জন্য বসে বা শুয়ে থাকা উচিত।
রক্তদানের পর ভারি কাজ, শারীরিক পরিশ্রম, ব্যায়াম বা ভারি জিনিস তোলা থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ রক্ত দিলে শরীরে স্বাভাবিকের থেকে কিছুটা দুর্বলতা দেখা দিতে পারে, যা বিশ্রাম নিলে দ্রুত কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এছাড়া রক্তদানের পর দুই থেকে তিন ঘণ্টা চা, কফি বা অন্য ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় পান করা থেকে বিরত থাকতে হবে, কারণ এগুলো আয়রন শোষণে বাধা দেয় এবং শরীরের পুষ্টির ভারসাম্য নষ্ট করে।
রক্তদান একটি সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এটি শুধু রোগীর জীবন বাঁচায় না, বরং রক্তদাতার শরীরকেও সুস্থ রাখতে সহায়তা করে। রক্তদানে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আরও বেশি মানুষ এই মহৎ কাজের সাথে যুক্ত হতে পারে।
পরিশেষে, রক্তদান একটি সহজ, নিরাপদ ও জীবনের জন্য অপরিহার্য কাজ, যা সমাজে এক অনন্য মানবিক বন্ধনের সূচনা করে। সঠিক প্রস্তুতি ও সতর্কতা মেনে চললে রক্তদান শারীরিকভাবে নিরাপদ ও ফলপ্রসূ হয়।
রক্তদানের আগে ও পরে এসব বিষয় মাথায় রেখে চললে রক্তদান আপনার এবং রক্তপ্রাপ্ত রোগীর জন্য সুখকর ও নিরাপদ অভিজ্ঞতা হয়ে উঠবে। তাই মানবতার সেবায় এগিয়ে আসুন, নিয়মিত রক্তদান করুন, আর বাঁচান এক জীবনের আলো।
বাংলাবার্তা/এমএইচ