
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) জন্য নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) রাজধানীর বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের সভাকক্ষে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর আনুষ্ঠানিকভাবে এ মুদ্রানীতি প্রকাশ করেন। এবারের মুদ্রানীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে অগ্রাধিকার দিয়ে নীতি সুদহার অপরিবর্তিত রেখেছে। পাশাপাশি আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা ও টেকসই প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন খাতে সুস্পষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
মুদ্রানীতিতে বলা হয়, মূল্যস্ফীতির ধারা কিছুটা নিম্নমুখী হলেও তা এখনো প্রত্যাশিত সীমায় আসেনি। জুন মাস শেষে গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ, যা বিগত সময়ের তুলনায় কম হলেও কাঙ্ক্ষিত ৬ দশমিক ৫ শতাংশের অনেক উপরে। গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, “আমাদের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হলো মূল্যস্ফীতিকে ৩ থেকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা। তবে বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকা, আমদানি ব্যয় হ্রাস ও কৃষি উৎপাদনে ইতিবাচক প্রবণতা থাকায় মূল্যস্ফীতি কমার ধারা অব্যাহত রয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “চাল ছাড়া অধিকাংশ ভোগ্যপণ্যের দাম বর্তমানে স্থিতিশীল। তবে বাজারে আস্থার অভাব, আমদানিকারকদের আগ্রহের ঘাটতি এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপের কারণে অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতির ওপর এখনো চাপ রয়ে গেছে।”
গভর্নর জানান, মূল্যস্ফীতি আশানুরূপ কমলে তবেই রেপো হার কমানো হবে। বর্তমানে প্রধান নীতি সুদহার (রেপো) ১০ শতাংশেই অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এই হারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিতে পারে। একই সঙ্গে স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি (এসএলএফ) ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ) ৮ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
গভর্নর বলেন, “এখন সময় এসেছে ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের সংস্কারের। আমরা বড় আকারে ‘সার্জারি’ করব, যাতে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে চিহ্নিত করে রাষ্ট্রীয় তহবিল দিয়ে তাদের পুঁজির জোগান দেওয়া যায়। তবে সেই টাকা সরকার সুদসহ ফেরত নেবে।” তিনি আমানতকারীদের উদ্দেশে আশ্বস্ত করে বলেন, “ব্যাংকে সঞ্চিত অর্থ নিরাপদ। আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।”
নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ (ডিসেম্বর পর্যন্ত) এবং ৮ শতাংশ (জুন পর্যন্ত)। গত অর্থবছরে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ, যেখানে অর্জিত হয়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৪ শতাংশ।
সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অপরিবর্তিত রেখে ১৮ দশমিক ১০ শতাংশে রাখা হয়েছে, যা আগের বছরেও একই ছিল। তবে সে সময় অর্জিত হয় মাত্র ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ।
চলতি মুদ্রানীতিতে মুদ্রা সরবরাহের সামান্য বৃদ্ধি করে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ, যা আগের মুদ্রানীতিতে ছিল ৮ দশমিক ৪০ শতাংশ। তবে অর্জিত হয়েছে ৭ শতাংশ। এতে বোঝা যায়, অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও বিনিয়োগ এখনো প্রত্যাশিত মাত্রায় ফেরেনি।
অর্থনীতির সামগ্রিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫০ শতাংশ, যা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বিনিয়োগ প্রবাহের ওপর নির্ভরশীল বলে জানানো হয়। গভর্নর বলেন, “বর্তমান বাস্তবতায় ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি খারাপ নয়। প্রবৃদ্ধি নির্ভর করে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বাজারের আস্থার ওপর।”
নতুন মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক সুস্পষ্টভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা এবং অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান নিয়েছে। তবে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ প্রবাহ না বাড়লে প্রবৃদ্ধি কাঙ্ক্ষিত হারে অর্জন সম্ভব হবে না বলে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন। মুদ্রানীতি বাস্তবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা এবং আর্থিক শৃঙ্খলার বিকাশই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এই মুদ্রানীতির মাধ্যমে সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে—স্বল্পমেয়াদি স্থিতিশীলতা নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই হবে তাদের মূল লক্ষ্য।
বাংলাবার্তা/এমএইচ