
ছবি: সংগৃহীত
গাজায় শিশুদের জীবনের মূল্য যেন দিন দিন শূন্য হয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর একের পর এক নিন্দা আর প্রতিবাদ উপেক্ষা করেই ইসরাইলি বাহিনী চালিয়ে যাচ্ছে গণহত্যা। এমন নিষ্ঠুর বাস্তবতার মধ্যে এবার প্রকাশ্যে এলো এক হৃদয়বিদারক ঘটনা—খাবারের আশায় খালি পায়ে ১২ কিলোমিটার হেঁটে আসা এক ছোট্ট ফিলিস্তিনি শিশুকেও গুলি করে হত্যা করেছে ইসরাইল।
‘গাজার ছোট্ট আমির’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠা এই শিশু শুধুই একটি বাচ্চা ছেলেই ছিল না, বরং সে হয়ে উঠেছে ফিলিস্তিনি মানবিক সংকটের এক মর্মন্তুদ প্রতীক। তার শেষ মুহূর্তের বর্ণনা দিয়েছেন গাজায় অবস্থানরত গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ)-এর সাথে যুক্ত একজন প্রাক্তন মার্কিন সেনা সদস্য অ্যান্থনি আগুইলার। এই মানবিক স্বেচ্ছাসেবক বর্তমানে গাজার একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে কর্মরত আছেন।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট মনিটর–এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে অ্যান্থনি আগুইলারের সাক্ষাৎকারে উঠে আসে ছোট্ট আমিরের জীবনের শেষ অধ্যায়ের মর্মান্তিক চিত্র। তার ভাষায়, গত ২৮ মে, গরমে বিদ্ধস্ত গাজা শহরে অন্যান্য দিনগুলোর মতোই মানুষের ঢল নামে একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের সামনে। সেদিনও অগণিত মানুষ অল্প কিছু খাবারের আশায় দীর্ঘসময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন।
সে দিন একেবারে খালি পায়ে, ক্ষীণ ও দুর্বল শরীর নিয়ে এক শিশু ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ায় লাইনের এক প্রান্তে। সেই শিশুই ছিল আমির। প্রায় ১২ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে এসেছিল সে, প্রচণ্ড রোদে তার ত্বক ঝলসে যাচ্ছিল। গায়ে ছিল ধুলো-ধূসরিত ছেঁড়া জামা, হাতে কোনো পাত্রও ছিল না, শুধু ছিল খাবারের আশা।
অ্যান্থনি বলেন, “আমি ওকে দেখে থমকে গিয়েছিলাম। ওর চোখে ক্লান্তি ছিল, কিন্তু তবুও একটা মিষ্টি হাসি ছিল ঠোঁটে। আমি কিছু শুকনা খাবার ওর হাতে তুলে দিতেই সে আমার হাত চুমু খায়, খুব শান্ত কণ্ঠে বলে, ‘থ্যাঙ্ক ইউ।’ এরপর নিজের ছোট্ট ব্যাগে খাবার রেখে ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে যায়।”
কয়েক মিনিট পরেই গর্জে ওঠে ইসরাইলি ড্রোন ও কামান। ভিড়ের মধ্যে ছোড়া হয় গুলি ও বোমা। যারা খাবার পেয়ে বাড়ি ফিরছিল, তাদের ওপর শুরু হয় আচমকা আক্রমণ। সেই হামলায় ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায় ছোট্ট আমির।
“আমি জানতাম না যে তার সঙ্গে এটাই আমার শেষ দেখা। সে চলে গেল, তার গন্তব্য ছিল শুধু একটু খাবার। কিন্তু ফিরল না। গাজায় এমন ঘটনা প্রতিদিন ঘটে, কিন্তু আমির ছিল ভিন্ন। ওর চোখে একটা যুদ্ধ ছিল, কিন্তু ওর হাত খালি ছিল ভালোবাসা দিয়ে ভরা,” বলেন অ্যান্থনি, যার চোখে তখন অশ্রু টলমল করছিল।
গাজার মানবিক বিপর্যয়ের পরিসংখ্যান এখন শুধুই সংখ্যা নয়, একেকটি নাম, একটি করে ছোট্ট জীবন। আমির পেয়েছিল কেবল এক মুঠো চাল ও কিছু ডাল—যা পড়ে গিয়েছিল মাটিতে। তারপরও সে কুড়িয়ে নিয়েছিল খাবারগুলো, কারণ গাজার শিশুরা জানে প্রতিটি দানাই জীবনের মূল্য।
জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফ জানিয়েছে, গাজা উপত্যকায় শিশু মৃত্যুর সংখ্যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। কিন্তু তারপরও কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া কার্যকর হচ্ছে না। প্রতিদিন শিশু, নারী ও বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে খাবার, পানি, ওষুধ কিংবা শুধুই নিরাপদ আশ্রয়ের আশায়।
অ্যান্থনি আগুইলার তার বিবৃতির শেষে বলেন, “গাজার অন্যান্য দিনগুলোর থেকে ওই দিনটি আলাদা ছিল না — তবে মৃত্যু এসেছিল দ্রুত।” তার মতে, এই শিশুদের মৃত্যু কোনো দুর্ঘটনা নয়, বরং এটি একটি সিস্টেমেটিক নির্মূল প্রক্রিয়া, যা আন্তর্জাতিক নীরবতায় আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে।
আমিরের মৃত্যু কেবল একটি শিশুর নিঃশেষ হয়ে যাওয়া নয়, এটি এক জাতির যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি। বিশ্বব্যাপী লাখো মানুষ এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানালেও, এখন পর্যন্ত বড় পরিসরে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা দেখা যায়নি।
ছোট্ট আমির, যার মুখে ছিল ধন্যবাদ, যার হাতে ছিল চুম্বনের ছোঁয়া, তাকে গুলি করে হত্যা করাও যেন এখন গাজায় একটি “সাধারণ” ঘটনা। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটুক—এই আশা এখন শুধু গাজার নয়, মানবতারও।
সূত্র: মিডল ইস্ট মনিটর
বাংলাবার্তা/এমএইচ