
ছবি: সংগৃহীত
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও সম্প্রতি ফক্স রেডিওকে দেওয়া এক বিস্তৃত সাক্ষাৎকারে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের বিষয়ে তার দেশের স্পষ্ট অবস্থান তুলে ধরেছেন। তার বক্তব্যে উঠে এসেছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা—ইসরাইল যদি না চায়, তবে পৃথিবীর কোনো শক্তিই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করতে পারবে না।
তার মতে, পশ্চিমা দেশগুলোর সাম্প্রতিক উদ্যোগ—ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত—আসলে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ এবং বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। বরং এমন সিদ্ধান্ত ‘শান্তির পথে বাধা’ সৃষ্টি করছে এবং চলমান সংঘর্ষ নিরসনে ‘প্রতিবন্ধকতা’ হিসেবে কাজ করছে।
রুবিও তার সাক্ষাৎকারে বলেন, “পশ্চিমা দেশগুলো বলতে পারে না ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ঠিক কোথায় হবে, কে সেখানে শাসন করবে কিংবা কীভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। তাদের বক্তব্যের মধ্যে কোনো সুসংহত রূপরেখা নেই। আর বাস্তবতা হচ্ছে—ইসরাইলের সম্মতি ছাড়া এই রাষ্ট্র কখনোই বাস্তবে রূপ নেবে না।”
তিনি আরও যোগ করেন, “অনেক রাষ্ট্র নিজের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চাপ সামলাতে গিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ভারসাম্য নষ্ট করছে। তারা হয়তো ভাবছে, এক তরফা স্বীকৃতি শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ খুলে দেবে। কিন্তু সত্যি হলো, এটি উল্টো কাজ করছে।”
রুবিও দাবি করেন, “হামাস এখনও অন্তত ২০ জন মানুষকে জীবিত জিম্মি করে রেখেছে এবং ৫০ জনের বেশি মানুষের মরদেহ আটকে রেখেছে। অথচ যারা ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিচ্ছেন, তারা কার্যত হামাসের পক্ষেই অবস্থান নিচ্ছেন।”
তার ভাষায়, “হামাসের পক্ষে অবস্থান মানেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে থাকা। এটি এক ধরনের পুরস্কার, যা সন্ত্রাসবাদের জন্য উদ্বুদ্ধকারী বার্তা পাঠাচ্ছে।”
তিনি বলেন, “এই স্বীকৃতি প্রক্রিয়া চলমান যুদ্ধবিরতি আলোচনায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। হামাসকে এক অর্থে এটা বলছে—তোমাদের অস্ত্র চালিয়ে যাও, আন্তর্জাতিক সমর্থন তবুও থাকবে। এমন সংকেত শান্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।”
অন্যদিকে, যেসব দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে—তারা বলছে, এটি কোনো রাজনৈতিক পুরস্কার নয়, বরং দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানকে এগিয়ে নেওয়ার একটি কূটনৈতিক প্রক্রিয়া। তাদের মতে, যদি ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘদিনের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে স্বীকৃতি না দেওয়া হয়, তবে শান্তির পথ কখনোই তৈরি হবে না।
স্পেন, আয়ারল্যান্ড ও নরওয়ের মতো দেশগুলো একে “টেকসই শান্তির পূর্বশর্ত” হিসেবে দেখছে। তারা মনে করে, ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলে তাদের সঙ্গে আলোচনার সুযোগ তৈরি হবে, এবং ভবিষ্যতে জেরুজালেম, সীমান্ত, নিরাপত্তা, উদ্বাস্তু এবং পানির অধিকার—এই জটিল বিষয়গুলোর আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে।
রুবিওর বক্তব্যে আবারও উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক ইসরাইলকেন্দ্রিক নীতি। মার্কিন প্রশাসন বরাবরই বলে আসছে, শান্তির জন্য প্রত্যক্ষ আলোচনার মাধ্যমেই ইসরাইল ও ফিলিস্তিনকে সমাধানে পৌঁছাতে হবে, তৃতীয় কোনো পক্ষ একতরফাভাবে রাষ্ট্র ঘোষণা বা স্বীকৃতি দিয়ে সমাধান চাপিয়ে দিতে পারে না।
রুবিও বলেন, “তাদের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবতা পাল্টাবে না। বরং এটি একধরনের কল্পনাবিলাস। তারা হয়তো নিজেরাই বুঝতে পারছে না যে, এমন স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে তারা হামাসের মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে উৎসাহিত করছে যুদ্ধবিরতি না মানতে এবং জিম্মিদের মুক্তি না দিতে।”
ইসরাইল এই অবস্থানে স্বস্তি প্রকাশ করেছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বুঝে গেছে—আন্তর্জাতিক চাপ দিয়ে বা ফিলিস্তিন রাষ্ট্র চাপিয়ে দিয়ে শান্তি সম্ভব নয়। সত্যিকারের শান্তি তখনই সম্ভব, যখন ফিলিস্তিনিরা সন্ত্রাস ত্যাগ করবে এবং ইসরাইলকে একটি বৈধ রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নেবে।”
বিশ্ব রাজনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন, ফিলিস্তিন ইস্যুতে বিশ্ব এখন দুই বিপরীত মেরুতে বিভক্ত। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা যাদের মতে শান্তি কেবল আলোচনার মাধ্যমে সম্ভব, অন্যদিকে ইউরোপের কিছু দেশ ও দক্ষিণ গোলার্ধের বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র বলছে—ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্বীকৃতিই হচ্ছে শান্তির ভিত্তি।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা জাতিসংঘ সরাসরি অবস্থান না নিলেও, সেখানে অনেক সদস্যরাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিচ্ছে, যা আবার মার্কিন নেতৃত্বাধীন ধারা থেকে এক ধরনের বিচ্যুতি হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর বক্তব্যে স্পষ্ট—ইসরাইল যদি রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনকে মানতে না চায়, তবে অন্য সব রাষ্ট্রের স্বীকৃতিও অর্থহীন। একই সঙ্গে তিনি এটিকে সন্ত্রাসবাদের প্রতি পরোক্ষ সমর্থন হিসেবেও বিবেচনা করছেন।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতিকে কেন্দ্র করে এখন আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্ব হয়তো দীর্ঘ সময় ধরে এই ইস্যুতে বিভক্তই থাকবে—যতদিন না বাস্তব কোনো রাজনৈতিক সমঝোতা আসে তেলআবিব ও রামাল্লাহর মধ্যে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ