
ছবি: সংগৃহীত
আফগান শরণার্থীদের জন্য ইরান যেন এক অঘোষিত শাস্তির জায়গা হয়ে উঠেছে। ইসরায়েলের গুপ্তচর সন্দেহে, বৈধ কাগজ থাকা সত্ত্বেও, এমনকি আন্তর্জাতিক শরণার্থী নীতিমালার তোয়াক্কা না করেই, ইরান থেকে একের পর এক আফগান নাগরিককে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি প্রকাশিত এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ভয়ংকর এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র—যেখানে বলা হয়েছে, ইরান সরকার এখন পর্যন্ত ১৫ লাখের বেশি আফগান নাগরিককে জোর করে তাদের নিজ দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ফেরত পাঠানো আফগানদের বেশির ভাগই অভিযোগ করছেন যে, তাদেরকে নির্মমভাবে নির্যাতন করে সীমান্তে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ‘ইসরাইলের গুপ্তচর’ আখ্যা দিয়ে অনেকে মারধরের শিকার হয়েছেন।
আলি আহমেদ নামের এক ভুক্তভোগী তার পিঠের আঘাতের চিহ্ন দেখিয়ে বলেন, “আমার কোনো দোষ ছিল না। শুধু নাম ঠিকানা দেখে আমাকে তুলে নেয়। তারা পানি বহনের প্লাস্টিক পাইপ, লোহার রড, এমনকি কাঠের বোর্ড দিয়ে পেটায়। আমার মোবাইল ফোন, টাকা-পয়সাও কেড়ে নেয়। তাদের আচরণ ছিল একেবারে পশুর মতো। আর সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার—তারা আমাকে ইসরাইলের গুপ্তচর বলে তকমা দেয়।”
শুধু অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা নয়, যাদের বৈধ ভিসা রয়েছে, তারাও ইরানি পুলিশের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। অনেকে জানান, পুলিশ তাদের বৈধ কাগজপত্র ছিঁড়ে ফেলে, এমনকি কাস্টডিতে নেওয়ার সময় কোনও ব্যাখ্যা পর্যন্ত দেয় না।
তাদের ভাষ্যমতে, নির্যাতনের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ যে কেউ কেউ মার খেয়ে অজ্ঞান হয়ে যান। অনেকে তো ইরানের পুলিশ হেফাজতে থাকাকালে মারা গেছেন বলেও অভিযোগ তুলেছেন।
বিশ্লেষক ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, ইরানের এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন এবং শরণার্থী সনদের সম্পূর্ণ লঙ্ঘন। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (UNHCR) ইতোমধ্যে এ বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে।
বিশ্লেষকদের ভাষায়, ইরান তার ভেতরের নিরাপত্তা ব্যর্থতা ঢাকতে এবং সামগ্রিক রাজনৈতিক চাপ থেকে দৃষ্টি সরাতে আফগানদের বলির পাঠা বানাচ্ছে। অথচ এসব শরণার্থীর একটা বড় অংশ তালেবান শাসনের সময় নিজেদের জীবন বাঁচাতে পালিয়ে ইরানে গিয়েছিল।
ইরানের সরকারি অবস্থান: 'জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় বাধ্য'
ইরান সরকার অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন সুরে কথা বলছে। তাদের ভাষ্যমতে, দেশটিতে ৪০ লাখের বেশি অবৈধ আফগান নাগরিক অবস্থান করছে। এর মধ্যে এক বড় অংশ অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে কিংবা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে বলে দাবি করছে তারা।
সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “ইরান সবসময় মানবিক ও ইসলামী নীতিমালার আলোকে শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু যারা অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে, ভিসার শর্ত লঙ্ঘন করে, বা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়—তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া আমাদের বৈধ অধিকার।”
তালেবান সরকারের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের জুন মাসের ২২ তারিখ থেকে জুলাইয়ের ২২ তারিখ পর্যন্ত এক মাসেই ৯ লাখের বেশি আফগানকে ইরান থেকে দেশে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গোটা বছরজুড়েই ফেরত পাঠানোর হার রেকর্ড মাত্রায় বেড়েছে।
অন্যদিকে, মার্চ মাসেই ইরান সরকার ঘোষণা দেয় যে তারা অবৈধ অবস্থানরত সকল আফগানকে ‘স্বেচ্ছায় দেশে ফিরে যাওয়ার’ নির্দেশ দেবে। তবে বাস্তবতা হলো, এ নির্দেশ ‘স্বেচ্ছা’ নয় বরং একপ্রকার জোরপূর্বক প্রত্যাবাসন—যেখানে নির্যাতনের পাশাপাশি ব্যক্তিগত সম্পদ ছিনতাই, আটক, এমনকি বন্দিত্বের শিকার হচ্ছেন বহু আফগান।
ইরান-আফগান সীমান্ত এখন এক বিশৃঙ্খল মানবিক সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন শত শত মানুষ সীমান্তে এসে দাঁড়াচ্ছে। অনেকে আহত, অনেকে নিঃস্ব, অনেকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।
তালেবান সরকার সীমান্তে জরুরি ক্যাম্প স্থাপন করেছে, তবে অবকাঠামো ও মানবিক সহায়তার অভাবে এই ক্যাম্পগুলোও কার্যকর সেবা দিতে পারছে না। ফলে ফেরত আসা মানুষদের একটি বড় অংশ চরম অনিশ্চয়তা ও মানবেতর অবস্থার মধ্যে পড়েছে।
ইরান থেকে আফগানদের ফেরত পাঠানো শুধু একটি রাজনৈতিক বা অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ইস্যু নয়, এটি বর্তমানে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার অন্যতম বড় মানবিক সংকট হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
আন্তর্জাতিক মহলের এখনই উচিত এ বিষয়ে সরব হওয়া—কারণ যেসব নিরীহ আফগান নাগরিক শুধুমাত্র জীবিকার সন্ধানে ইরানে পাড়ি জমিয়েছিলেন, আজ তাঁদের ওপরই নেমে এসেছে জাতির শত্রু হবার তকমা ও প্রাণঘাতী নির্যাতনের ঝড়।
এই পরিস্থিতিতে মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ব শক্তিগুলোর একটি সমন্বিত, কঠোর ও মানবিক প্রতিক্রিয়া না থাকলে, শরণার্থীদের এই দুঃখগাঁথা আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ