
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কিছু কর্মকাণ্ড ভারতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে উদ্বেগ তৈরি করেছে। বিশেষ করে ‘সালতানাত-ই-বাংলা’ নামের একটি ইসলামপন্থি গোষ্ঠীর কথিত মানচিত্র প্রকাশের ঘটনায় ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) এক সংসদ সদস্য ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এই প্রেক্ষাপটে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, নয়াদিল্লি বাংলাদেশের পরিস্থিতির ওপর নিবিড়ভাবে নজর রাখছে এবং ভারতের জাতীয় স্বার্থ ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে।
ভারতের জাতীয় সংসদের চলমান বর্ষাকালীন অধিবেশনে জয়শঙ্করের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন বিজেপির এক সংসদ সদস্য। তিনি জানান, সম্প্রতি বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ‘সালতানাত-ই-বাংলা’ নামের একটি সংগঠন একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করে, যেখানে তথাকথিত ‘গ্রেটার বাংলাদেশ’ নামে একটি মানচিত্র উপস্থাপন করা হয়। এই মানচিত্রে ভারতের আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও ওড়িশার কিছু অংশসহ ভারতের একাধিক রাজ্যকে বাংলাদেশের অংশ হিসেবে দেখানো হয়। এ ছাড়া অভিযোগ করা হয়, তুরস্কভিত্তিক এনজিও ‘তার্কিশ ইউথ ফেডারেশন’ এই কর্মকাণ্ডের পেছনে মদত দিচ্ছে।
এমপি আরও বলেন, এই ধরনের কর্মকাণ্ড ভারতের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি এবং কৌশলগতভাবে উদ্বেগের বিষয়। তিনি দাবি করেন, এই গোষ্ঠী বাংলাদেশে উগ্রপন্থি ধর্মীয় আদর্শ ছড়িয়ে দিচ্ছে এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে।
প্রতিবাদ ও উদ্বেগের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর বলেন, “আমরা এই ইস্যুটি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখছি। বাংলাদেশ সরকারের সাথে এ বিষয়ে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আমাদের জানানো হয়েছে, এটি মূলত একটি ঐতিহাসিক প্রদর্শনী ছিল, যা ২০২৫ সালের ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।”
তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশ সরকার জানিয়েছে, ঐ প্রদর্শনীতে মধ্যযুগীয় বাংলার ইতিহাস সম্পর্কিত একটি মানচিত্র প্রদর্শন করা হয়েছিল, যা বর্তমান রাজনৈতিক মানচিত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। আয়োজকেরা নিশ্চিত করেছেন, এর সঙ্গে কোনো বিদেশি সংস্থার সম্পৃক্ততা নেই। এছাড়া ‘সালতানাত-ই-বাংলা’ নামে বাংলাদেশের ভেতরে কোনো আনুষ্ঠানিক সংগঠনের অস্তিত্ব নেই বলেও সরকার জানিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের ফ্যাক্টচেক প্ল্যাটফর্ম ‘বাংলাফ্যাক্ট’-এর তথ্যানুসারে, এসব দাবি বিভ্রান্তিকর এবং কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই।”
এস. জয়শঙ্কর আরও বলেন, “আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিই। বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমন এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে আমরা বাংলাদেশকে ঘিরে যেকোনো অগ্রগতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশে কী ঘটছে তা আমাদের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।”
তিনি বলেন, “যেকোনো বিভ্রান্তিকর প্রচারণা, মানচিত্র রাজনীতি কিংবা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত পেলে আমরা সতর্ক থাকব এবং প্রয়োজনে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করব।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কের উষ্ণতা ছিল দৃশ্যমান, বিশেষ করে বাণিজ্য ও সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতায়। তবে রাজনৈতিক পালাবদল বা অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা এ ধরনের অপ্রত্যাশিত ইস্যু উসকে দিতে পারে। জয়শঙ্করের বক্তব্য স্পষ্টতই এ ধরনের সম্ভাবনাকে অগ্রাহ্য করছে না বরং ভারতীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সজাগ ভূমিকার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এমন সময় এই বিতর্ক উঠল যখন বাংলাদেশে একটি নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেছে এবং ঢাকা-দিল্লি কূটনৈতিক সম্পর্কের গতিপথ পুনর্মূল্যায়নের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘গ্রেটার বাংলাদেশ’ বা ঐতিহাসিক মানচিত্রকে কেন্দ্র করে উস্কানি মূলক প্রচারণা উভয় দেশের মধ্যেই রাজনৈতিক হাওয়া গরম করতে পারে। তবে দুই দেশের সরকার সচেতন থাকলে এ ধরনের বিভ্রান্তিকর কাহিনি কূটনৈতিক বা নিরাপত্তাগত টানাপোড়েনে রূপ নেবে না।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করের বক্তব্য স্পষ্ট করে দিল যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে প্রদর্শিত মানচিত্র ঘিরে যতটুকু বিতর্ক উঠেছে, তা বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টিতেও গুরুত্ব পেয়েছে এবং তারা এর প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা দিয়েছে। তবে ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি এখনও সংবেদনশীল। ফলে ভবিষ্যতে এ ধরনের কর্মকাণ্ড ঠেকাতে নয়াদিল্লি ঢাকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ ও সমন্বয় জারি রাখবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ