
ছবি: সংগৃহীত
গাজা উপত্যকা এখন মৃত্যুপুরী। ইসরাইলের সামরিক আগ্রাসনে পুরো অঞ্চলের চেহারা পাল্টে গেছে—চারপাশে ধ্বংসস্তূপ, ধোঁয়ার কুন্ডলী, আর বেঁচে থাকা মানুষের হাহাকার। এই ভয়াবহ বাস্তবতায় জাতিসংঘের সদর দফতর থেকে হামাসকে অস্ত্র ত্যাগের আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু সেই আহ্বানের বিপরীতে সাফ জানিয়ে দিয়েছে হামাস—দখলদারিত্ব শেষ না হওয়া পর্যন্ত এবং পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত তাদের প্রতিরোধ সংগ্রাম চলবে।
বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) এক বিবৃতিতে হামাস বলেছে, “আমরা কোনো সাময়িক যুদ্ধবিরতি বা অস্ত্রবিরতির নামে প্রতিরোধ থামাতে পারি না। স্বাধীনতা অর্জনের আগেই শান্তির আহ্বান মানে হলো আত্মসমর্পণ, যা আমরা কখনোই করব না।”
সম্প্রতি নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে তিনদিনব্যাপী এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংকটের দুই-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের উপর জোর দেওয়া হয়। ফ্রান্স ও সৌদি আরবের যৌথ নেতৃত্বে আয়োজিত এই সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন—মঙ্গলবার (২৯ জুলাই)—একটি যৌথ ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হয়। এতে হামাসকে গাজার প্রশাসন থেকে সরে দাঁড়ানো এবং অস্ত্র পরিত্যাগ করার আহ্বান জানানো হয়।
ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছে ১৭টি দেশ। তাদের মধ্যে রয়েছে কাতার, সৌদি আরব, মিশর, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি ও আরও কয়েকটি পশ্চিমা শক্তিধর রাষ্ট্র। তারা দাবি করেছে, গাজার মানবিক সংকট নিরসনে রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং সহিংসতা বন্ধ করা জরুরি।
কিন্তু হামাসের প্রতিক্রিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন। সংগঠনটি একে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর 'দ্বিমুখী নীতি' বলে আখ্যা দিয়েছে। তারা বলছে, যারা ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কথা বলছে না, তারা কীভাবে অস্ত্র ত্যাগের আহ্বান করতে পারে?
এই পরিস্থিতিতে গাজা উপত্যকার মানবিক চিত্র দিনকে দিন ভয়াবহ হয়ে উঠছে। প্রতিদিন হাজারো মানুষ খাদ্য, পানি ও ওষুধের জন্য মরিয়া হয়ে উঠছে। তবে খাদ্য সহায়তা পৌঁছানো মানেই যেন মৃত্যুর ডাক। প্রতিটি খাদ্যবাহী ট্রাককে লক্ষ্য করে ইসরাইলি সেনারা গুলি চালাচ্ছে—বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে শিশু-কিশোর, নারী ও বয়স্কদের গুলিতে হত্যা করা হচ্ছে।
চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত সংস্থাগুলোর দাবি, একেকটি ত্রাণ ট্রাক ঘিরে পরিকল্পিত বিশৃঙ্খলা তৈরি করা হচ্ছে। তারপর সেই বিশৃঙ্খলার অজুহাতে চালানো হচ্ছে গুলি। অনেক সময় খাবার নিতে এসে একই পরিবারের একাধিক সদস্য নিহত হচ্ছেন।
সম্প্রতি ১২ কিলোমিটার খালি পায়ে হেঁটে আসা ছোট্ট এক শিশু—আমিরের মৃত্যুও আলোড়ন তুলেছে। শুধু খাবারের আশায় কষ্ট করে আসা সেই শিশুটিকেও রেহাই দেয়নি ইসরাইলি বাহিনী।
এই সংকটকালীন সময়েও গাজা সফরে এসে জাতিসংঘের কোনো প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ। বরং তিনি সময় দিয়েছেন ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ নামক একটি বিতর্কিত বেসরকারি সংস্থাকে।
জাতিসংঘ বারবার এই সংস্থার বিরুদ্ধে ত্রাণ বিতরণে অযোগ্যতা, অনিয়ম এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরির অভিযোগ তুলেছে। অনেকেই বলছেন, গাজায় মার্কিন কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডও এখন নিরপেক্ষতার বদলে পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে উঠেছে, যার ফলে সংকট আরও জটিল হচ্ছে।
গাজায় যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে কোনো স্থায়ী সমাধানে পৌঁছানো যাচ্ছে না বলেও স্বীকার করেছেন ইসরাইলি সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ ইয়াল জামির। তিনি বলেন, “পরবর্তী কয়েকদিনের মধ্যেই বোঝা যাবে যুদ্ধবিরতির কোনো সুযোগ আছে কি না।”
একই সঙ্গে জামির দাবি করেন, “গাজায় যে দুর্ভিক্ষ চলছে বলা হচ্ছে, তা প্রকৃতপক্ষে একটি ভুয়া প্রচার।” তার এই মন্তব্য আন্তর্জাতিক মহলে আরও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যখন জাতিসংঘ, রেড ক্রস, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিভিন্ন ত্রাণ সংস্থা গাজার মানবিক সংকট নিয়ে একযোগে উদ্বেগ প্রকাশ করছে, তখন এমন বক্তব্য ইসরাইলের চরম অমানবিক অবস্থানকেই তুলে ধরছে।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো—এই প্রতিরোধ কতটা দীর্ঘ হবে? হামাসের ঘোষণায় স্পষ্ট, তারা কোনো আন্তর্জাতিক চাপে নতিস্বীকার করবে না। তারা মনে করে, অস্ত্র ত্যাগ মানেই জনগণের আত্মসমর্পণ। অন্যদিকে, পশ্চিমা দেশগুলো মানবিকতার কথা বলে রাজনৈতিক চাপে ফিলিস্তিনিদের অস্ত্রহীন করতে চায়, অথচ ইসরাইলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।
অতএব, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা অর্জন না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ অব্যাহত থাকবে—এটিই এখন হামাসের অবস্থান। আর সেই প্রতিরোধের মূল্য গাজাবাসীকে দিতে হচ্ছে প্রাণ, রক্ত, ঘরবাড়ি আর ভবিষ্যতের বিনিময়ে।
এ সংকটে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব হলো—নিরপেক্ষ, কার্যকর ও টেকসই একটি সমাধান নিশ্চিত করা, যা শুধু অস্ত্রবিরতি নয়, বরং ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকারের স্বীকৃতিও নিশ্চিত করে। তা না হলে এই রক্তস্নাত প্রতিরোধ থামবে না—তাও দিনের পর দিন, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ