
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বাণিজ্য চুক্তিকে ‘ঐতিহাসিক অর্জন’ ও ‘সুস্পষ্ট কূটনৈতিক সাফল্য’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ শুধু নিজের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে তা-ই নয়, বরং বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ও কৌশলগত অবস্থানও নতুন মাত্রায় উন্নীত হয়েছে। শুক্রবার (১ আগস্ট) এক শুভেচ্ছা বার্তায় তিনি দেশের শুল্ক আলোচক দলকে আন্তরিক অভিনন্দন জানান এবং তাদের ‘অসাধারণ কৌশলগত দক্ষতা’ ও ‘দূরদর্শী নেতৃত্বের’ প্রশংসা করেন।
চুক্তি অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের একাধিক পণ্যের ওপর শুল্কহার কমিয়ে ২০ শতাংশে নামিয়ে এনেছে, যা পূর্ববর্তী হারের তুলনায় প্রায় ১৭ শতাংশ কম। এর ফলে বাংলাদেশের জন্য বিশ্বের বৃহত্তম ভোক্তা বাজারে প্রবেশাধিকার আরও বিস্তৃত হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা জানান, “এই হ্রাস শুধুমাত্র এককালীন আর্থিক সুবিধা নয়—এটি আমাদের পণ্য প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রাখবে, রপ্তানিকারকদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করবে এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করবে।”
প্রধান উপদেষ্টার মতে, বাংলাদেশের আলোচকরা অত্যন্ত প্রতিকূল ও জটিল আলোচনার মধ্য দিয়েই এই চুক্তি অর্জন করেছেন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এই আলোচনা প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া টিমটি ধারাবাহিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে অংশ নেয়। এসব আলোচনায় কেবলমাত্র শুল্ক হারের বিষয়টি নয়, বরং অ-শুল্ক বাধা, কাস্টমস মানদণ্ড, বাণিজ্যিক মান নিয়ন্ত্রণ এবং জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক নানা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু আলোচনায় উঠে আসে। দীর্ঘ আলোচনার পর চূড়ান্ত সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব হয়, যা বাংলাদেশের জন্য অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে।
তিনি বলেন, “এই অর্জন আমাদের আলোচকদের দূরদৃষ্টি, পেশাদারিত্ব ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের প্রতি তাদের অবিচল দায়বদ্ধতার এক উজ্জ্বল নিদর্শন।” তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশের আলোচক দল তাদের যুক্তি ও তথ্যের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের সন্তুষ্ট করতে পেরেছে, যা এই চুক্তিকে সম্ভব করেছে।”
এই বাণিজ্যিক সাফল্যের প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী উপদেষ্টা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন যে, এ অর্জন বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তির বিশ্ব স্বীকৃতির একটি নিদর্শন। “এই চুক্তি বহির্বিশ্বে আমাদের সক্ষমতা, আত্মবিশ্বাস এবং কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক গতিপথের প্রতি একটি স্পষ্ট বার্তা পৌঁছে দিয়েছে।”
তিনি বলেন, “আজকের সাফল্য কেবল বর্তমান পরিস্থিতিতে উপকার বয়ে আনবে না, বরং এটি ভবিষ্যতের জন্য সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে। নতুন বিনিয়োগ, বহুজাতিক অংশীদারিত্ব এবং রপ্তানি বৈচিত্র্যে এটি বড় ভূমিকা রাখবে।”
অধ্যাপক ইউনূস তার বার্তায় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতি সম্পর্কে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, “বাংলাদেশ আজ যে অবস্থানে এসে পৌঁছেছে, তা বহু বছরের কৌশলগত পরিকল্পনা, অর্থনৈতিক সংস্কার এবং পেশাদার প্রশাসনিক প্রচেষ্টার ফসল।” তিনি আরও বলেন, “এই চুক্তি আমাদের প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে এবং দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের পথে নতুন আস্থা যোগাবে।”
প্রধান উপদেষ্টা মনে করেন, “বাংলাদেশ এখন আর কেবল শ্রমনির্ভর উৎপাদন বা নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের পর্যায়ে আবদ্ধ নয়। এ ধরনের আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে আমরা বৈশ্বিক বাজারে এক নতুন পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করছি—একটি আত্মবিশ্বাসী, উদীয়মান এবং অংশীদারিত্বে আগ্রহী দেশ হিসেবে।”
বিশ্ব রাজনীতি ও বাণিজ্যের জটিল পরিবেশে এ ধরনের চুক্তি অর্জন যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা তুলে ধরে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “এই চুক্তি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কাঠামোয় বাংলাদেশের সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করবে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ডব্লিউটিওসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে বাংলাদেশ একটি ‘প্রতিশ্রুতিশীল ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার’ হিসেবে পরিচিত হবে।”
তিনি সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, এনবিআর ও বাংলাদেশ দূতাবাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিরলস পরিশ্রমের জন্য ধন্যবাদ জানান এবং আশা প্রকাশ করেন, ভবিষ্যতেও এ ধরনের সাফল্য আরও বাড়বে।
প্রধান উপদেষ্টার এই বিবৃতি কেবল একটি সাফল্যের ব্যাখ্যা নয়, বরং এটি বাংলাদেশের কূটনৈতিক পররাষ্ট্রনীতির পরিণত রূপের প্রতিচ্ছবি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে করা এই চুক্তি যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে, তা নিয়ে সংশয় নেই। বাংলাদেশের জন্য এ সাফল্য কেবল তাত্ক্ষণিক অর্থনৈতিক লাভ নয়, বরং এটি ভবিষ্যতের অগ্রগতির ভিত্তিও স্থাপন করেছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ