
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর আরোপিত পালটা শুল্কের হার ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। এই খবরে রপ্তানিকারকদের মাঝে যেমন কিছুটা স্বস্তি এসেছে, তেমনি নানামুখী শর্ত ও কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে বাস্তব সুবিধা কতটা মিলবে—সে নিয়েও তৈরি হয়েছে সংশয়। অর্থনীতিবিদ ও শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুল্ক হ্রাসের সুযোগ কাজে লাগাতে হলে শুধু কাগজে নয়, বাস্তবে প্রস্তুত থাকতে হবে শিল্প অবকাঠামো, সরবরাহ চেইন ও বাণিজ্য নীতিকে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, "শুল্ক কমার ফলে অনেকেই মনে করছেন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের অবস্থান আরও মজবুত হলো। কিন্তু বিষয়টা এতটা সরল নয়। বাড়তি শুল্ক কারা কতটুকু বহন করছে, সেটা আগে দেখতে হবে। যদি উদ্যোক্তাদের ওপর পড়ে, তাহলে তাদের লাভ কমবে। আবার আমদানিকারকের ওপর চাপলে, সেটা দেশের বাইরে ব্যবসার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।"
তিনি আরও বলেন, "এই ছাড় বাস্তবায়নে আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। বিদ্যুৎ, গ্যাস, লজিস্টিকস, পোর্ট ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি থাকলে শুধু শুল্ক কমিয়ে লাভ হবে না।"
অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন সরাসরি অবকাঠামোগত সমস্যা ও ব্যবস্থাপনা দুর্বলতার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, "শুল্ক কমে গেছে, কিন্তু উৎপাদন যদি সময়মতো শেষ না হয়, তাহলে সেই সুবিধার মানে দাঁড়ায় না। দেশে গ্যাস সংকটে বহু কারখানা সময়মতো উৎপাদন শেষ করতে পারে না। তারপরও বন্দর থেকে পণ্য জাহাজে উঠাতে এক সপ্তাহ লেগে যায়। আবার এনবিআরের কাগজপত্রের জটিলতায় অনেক সময় অর্ডার বাতিল হয়।"
তিনি আরও বলেন, "অভ্যন্তরীণ শ্রমিক অসন্তোষও আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের চোখে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করে। কেউ কেউ তো ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ লেখা দেখলেই পণ্য কিনতে চায় না, কারণ তাদের ধারণা এখানে শ্রমিকদের শোষণ করা হয়। এসব বদনাম যদি কাটাতে না পারি, তাহলে শুল্ক কমানোর সুযোগ কাজে লাগানো কঠিন হয়ে পড়বে।"
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন বাণিজ্য নীতির আওতায় ‘ট্রান্সশিপমেন্ট ট্যারিফ’ একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে বাংলাদেশের জন্য। কারণ বাংলাদেশের তৈরি পণ্যের বেশিরভাগ কাঁচামালই আসে চীন থেকে।
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, "যেহেতু বাংলাদেশ চীন থেকে কাঁচামাল এনে পণ্য তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে, সে ক্ষেত্রে ‘ট্রান্সশিপমেন্ট ট্যারিফ’ আরোপ হলে বাড়তি ৪০ শতাংশ শুল্ক দিতে হতে পারে। অর্থাৎ ২০ শতাংশ পালটা শুল্ক কমলেও ট্রান্সশিপমেন্ট ট্যারিফ যোগ হলে প্রতিযোগিতার সক্ষমতায় আবার পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।"
শুল্ক কমানোর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ কী কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছে—তা এখনও পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। তবে অর্থনীতিবিদদের ধারণা, এখানে শুধু বাণিজ্য নয়, কৌশলগত ও ভূ-রাজনৈতিক বিষয়ও জড়িত রয়েছে।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৫টি বোয়িং বিমান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অঙ্গীকার হিসেবে ধরা হচ্ছে। এছাড়া গম ও তুলা আমদানির বিষয়েও আগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, "অনেক দেশই যুক্তরাষ্ট্রকে বলছে যে তারা আমদানি বাড়াবে, আমরাও তাই বলেছি। তবে বাংলাদেশ ঠিক কী কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আমরা তা এখনো জানি না। আমাদের জন্য প্রশ্ন হলো—এই চুক্তি করে আমরা কী পেয়েছি আর কী হারিয়েছি।"
চুক্তি স্বচ্ছ না হওয়ায় সমালোচনা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, "সরকারকে উচিত পুরো চুক্তিটি প্রকাশ করা। কেবল শুল্ক নয়, এখানে হয়তো বিনিয়োগ, নিরাপত্তা, সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়, এমনকি কৌশলগত বাণিজ্য বিষয়েও চুক্তি হয়েছে। যদি এমন কিছু থাকে যা আমাদের অন্য বাণিজ্যিক অংশীদারদের ক্ষুব্ধ করে, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে তা আমাদের অর্থনীতিকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।"
তিনি আরও বলেন, "বাংলাদেশ একক মার্কেট নির্ভর নয়। আমাদের ইউরোপ, চীন, ভারতসহ আরও অনেক অংশীদার রয়েছে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে ছাড় দেওয়া হয়েছে, সেটা যেন অন্য অংশীদারদের স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়—সেটা নিশ্চিত করা জরুরি।"
অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রে পালটা শুল্ক কমা বাংলাদেশের জন্য স্বস্তির বিষয়। তবে এই সুযোগ কাজে লাগাতে হলে কেবল রাজনীতিক বা কূটনৈতিক অঙ্গনে নয়, বরং শিল্প অবকাঠামো, পোর্ট, জ্বালানি, এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনাতেও একই সঙ্গে উন্নয়ন আনতে হবে। আর সবচেয়ে বড় বিষয়—চুক্তির সার্বিক তথ্য জনগণের সামনে প্রকাশ করা উচিত, যাতে বাণিজ্য, কূটনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে একটি সুসমন্বিত রূপরেখা তৈরি করা যায়। কারণ আজকের শুল্ক কমার সুসংবাদ, কালকের অব্যবস্থাপনায় যেন না ডুবে যায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ