
ছবি: সংগৃহীত
রাজনৈতিক অঙ্গনে জল্পনা-কল্পনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’। দীর্ঘদিন ধরে আলোচনার পর অবশেষে এটি বাস্তবায়নের পথে এগোচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে মধ্যরাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে আলোচনাকে আরও জোরালো করলেন দুই শীর্ষ উপদেষ্টা—তথ্য উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলম এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া।
গত ১ আগস্ট (শুক্রবার) গভীর রাতে, উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তার ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে এক গুরুত্বপূর্ণ স্ট্যাটাসে লিখেছেন, “জুলাই ঘোষণাপত্র এখন বাস্তবতা। ৫ আগস্টের মধ্যেই ঘোষিত হবে ঘোষণাপত্র। ঘোষণাপত্র ইস্যুকে গণআকাঙ্ক্ষায় বাঁচিয়ে রেখে এটা বাস্তবায়নের পথ সুগম করার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।”
অন্যদিকে, উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া আরও সংক্ষিপ্ত অথচ তাৎপর্যপূর্ণ এক স্ট্যাটাসে লেখেন, “জুলাই ঘোষণাপত্র আসছে...” — যা নেটমাধ্যমে নতুন করে রাজনৈতিক উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে।
সরকারি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, আগামী ৫ আগস্টের আগেই যে কোনো দিন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ করবেন। যদিও সরকার এখনো নির্দিষ্ট তারিখ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেনি, তবে উপদেষ্টাদের স্ট্যাটাস এবং সূত্রের তথ্য মিলিয়ে বোঝা যাচ্ছে, ঘোষণার সময় ঘনিয়ে এসেছে।
গভীর গোপনীয়তা বজায় রেখে খসড়াটি প্রস্তুত করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ঘোষণাপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে মোট ২৬টি দফা, যা রাষ্ট্রীয় সংস্কার, রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি, নাগরিক অধিকার, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং ভবিষ্যৎ নির্বাচন প্রক্রিয়া সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত অবস্থান স্পষ্ট করেছে।
জাতীয় ঐকমত্য নিশ্চিত করতে খসড়ার একটি কপি বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র কাছে পাঠানো হয়েছে। তাঁদের মতামতের ভিত্তিতে খসড়ার কিছু অংশে সংশোধনের সম্ভাবনাও রয়েছে বলে জানা গেছে।
এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে খসড়ায় সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পরামর্শ এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
২০২৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি প্রথম ঘোষণা দেয়, তারা ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ করবে। পরবর্তীতে ৩১ ডিসেম্বর তা প্রকাশের কর্মসূচি জানানো হলেও রাজনৈতিক বাস্তবতায় তা পিছিয়ে যায়।
এর আগে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারাদেশে ব্যাপক ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ঘটে। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ একটি জাতীয় সনদ হিসেবে আত্মপ্রকাশের দাবি পায়। প্রথম খসড়ায় বলা হয়েছিল, এই অভ্যুত্থান হয়েছে ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে। পরবর্তীতে তা সংশোধন করে বলা হয়, “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বানে জুলাই মাসে অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়।”
এই বিবৃতিগত পরিবর্তনও স্পষ্ট করে যে, সরকার চাইছে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বিতর্কহীন জাতীয় দলিল তৈরি করতে।
‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নিয়ে উপদেষ্টাদের মধ্যরাতের এই স্ট্যাটাস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি একটি রাজনৈতিক বার্তা, যা দেশজুড়ে জনমত তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বিশেষ করে উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের বক্তব্যে 'গণআকাঙ্ক্ষা'র প্রতি ইঙ্গিত এবং ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নের জন্য ধন্যবাদ জানানোর ভাষা—এই দলিলের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতাকেই তুলে ধরছে।
দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক রূপরেখা ও প্রশাসনিক সংস্কারের অন্যতম ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’। এখন শুধু অপেক্ষা, কখন এটি প্রকাশ হবে এবং কেমন প্রতিক্রিয়া জানাবে রাজনৈতিক দলগুলো, নাগরিক সমাজ, আন্তর্জাতিক মহল এবং সর্বোপরি দেশের জনগণ।
৫ আগস্টের মধ্যেই ঘোষণাপত্র প্রকাশের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হলে, এটি অন্তর্বর্তী সরকারের একটি বড় রাজনৈতিক মাইলফলক হয়ে থাকবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এখন দেখার বিষয়—ঘোষণাপত্র শুধু দলিল হয়েই থাকে, নাকি তা বাস্তবায়নের বাস্তব পথচলাও শুরু করে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ