
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বের ১৫টি দেশ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়ে নতুন করে আন্তর্জাতিক উদ্যোগের আহ্বান জানিয়েছে। ফ্রান্সের নেতৃত্বে গঠিত একটি জোট গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা, হামাসের হাতে আটক ইসরায়েলি বন্দিদের মুক্তি, এবং দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের ভিত্তিতে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে এক যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেছে। এই বিবৃতিতে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং ওশেনিয়ার ১৫টি দেশ স্বাক্ষর করেছে, যার মধ্যে রয়েছে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ফিনল্যান্ড, স্পেন, আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে, স্লোভেনিয়া ও মাল্টার মতো গুরুত্বপূর্ণ দেশ।
মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) রাতে ফরাসি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই যৌথ বিবৃতিটি প্রকাশ করে। এতে ফ্রান্সের পাশাপাশি যেসব দেশ স্বাক্ষর করেছে, তারা হলো: অ্যান্ডোরা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, পর্তুগাল, সান মারিনো, স্লোভেনিয়া এবং স্পেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ নীতিমালার ভিত্তিতে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল—দুইটি স্বাধীন, সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র—আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমান্তের ভেতরে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করবে, এটাই হতে হবে ভবিষ্যৎ সমাধানের মূল লক্ষ্য। এছাড়া গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীরকে একীভূত করে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) অধীনে আনার ব্যাপারেও জোর দেওয়া হয়।
এই ঘোষণার পূর্বপ্রসঙ্গ হিসেবে উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা হলো—গত সোমবার (২৮ জুলাই) যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে তিনদিনব্যাপী একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন শুরু হয়, যেখানে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল সংকটের রাজনৈতিক সমাধান খোঁজার লক্ষ্যে আলোচনা শুরু হয়। এই সম্মেলনের নেতৃত্ব দেয় ফ্রান্স ও সৌদি আরব। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র—দুই প্রধান পক্ষই এই সম্মেলন বর্জন করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েল ও তার মিত্রদের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও এই সম্মেলনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ নিজেদের অবস্থান সুস্পষ্ট করেছে যে, দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান এখন আর কেবল কূটনৈতিক প্রচেষ্টা নয়, বরং এক প্রকার নৈতিক ও মানবিক দাবিতে পরিণত হয়েছে।
বিবৃতিতে বিশেষভাবে প্রশংসা করা হয় ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সাম্প্রতিক বক্তব্যের, যেখানে তিনি ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি দেন—
৭ অক্টোবরের হামাসের ‘সন্ত্রাসী হামলা’র নিন্দা,
ইসরায়েলি বন্দিদের মুক্তি,
হামাসের নিরস্ত্রীকরণ চাওয়া,
বন্দিদের অর্থ প্রদান ব্যবস্থার বিলুপ্তি,
শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার,
এক বছরের মধ্যে নির্বাচন এবং ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে বেসামরিকীকরণের প্রতিশ্রুতি।
এই বক্তব্য ও প্রতিশ্রুতি স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর দৃষ্টিতে একটি ‘নতুন সূচনার সুযোগ’ হিসেবে দেখা হচ্ছে, যেখানে সহিংসতা নয়, বরং রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতে স্থায়ী শান্তির সম্ভাবনা খোঁজা সম্ভব হতে পারে।
এই যৌথ বিবৃতির প্রেক্ষাপটে আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে ব্রিটেনে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমার মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) স্পষ্ট ভাষায় বলেন, সেপ্টেম্বরের মধ্যে ইসরায়েল গাজায় যুদ্ধবিরতি এবং মানবিক সহায়তা প্রবাহে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে, যুক্তরাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেবে।
এই ঘোষণা ইউরোপের রাজনীতিতে এক নতুন যুগের সূচনা ঘটাতে পারে বলেই বিশ্লেষকদের মত। কারণ যুক্তরাজ্য এতদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রায় সমান্তরাল কূটনৈতিক নীতি অনুসরণ করত, বিশেষ করে ইসরায়েল সংক্রান্ত বিষয়ে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে স্টারমার সরকার ফিলিস্তিন প্রশ্নে একটি স্বাধীন কণ্ঠস্বর তুলে ধরছে।
ফ্রান্সের নেতৃত্বাধীন ১৫ দেশের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, "আমরা আশা করি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়ে একটি কার্যকর শান্তি প্রক্রিয়া পুনরায় চালু করতে সহায়তা করবে। ইসরায়েলের সাথে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য, ফিলিস্তিনের পক্ষ থেকেও আঞ্চলিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের প্রচেষ্টা থাকা উচিত।"
অর্থাৎ, স্বাক্ষরকারী দেশগুলো কেবল ইসরায়েলকে চাপ দিতে নয়, বরং ফিলিস্তিনের নেতৃত্বকেও সংস্কারের পথ দেখিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ, টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে বলছে।
জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ইতোমধ্যে অন্তত ১৪২টি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে বা স্বীকৃতি দেওয়ার প্রক্রিয়ায় আছে। তবে এখনো যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য (আপাতত), ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকটি বড় সদস্য রাষ্ট্র আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি।
তবে গত মে মাসে নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড ও স্পেন ঘোষণা দেয়, তারা ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। এই ধারাবাহিকতায় ফ্রান্সও স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে, সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বার্ষিক সম্মেলনে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে তারা।
বিশ্ব রাজনীতিতে এই যৌথ বিবৃতি এক নতুন টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। যেখানে মানবিক বিপর্যয়, যুদ্ধ ও রাজনৈতিক অচলাবস্থার বিপরীতে শান্তিপূর্ণ, গ্রহণযোগ্য ও কূটনৈতিক সমাধানের এক দৃঢ় উদ্যোগ স্পষ্ট হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো—ইসরায়েল ও তার মিত্ররা এই আন্তর্জাতিক সুরে কতটা সাড়া দেবে, এবং একটি ন্যায্য ও টেকসই শান্তিচুক্তির দিকে বিশ্ব কতটা এগোতে পারবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ