
ছবি: সংগৃহীত
২০২৪ সালের আগস্ট মাসে শেখ হাসিনা দেশের বাইরে চলে যাওয়ার এক বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়। বরং গত বছরের ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার মানবাধিকার সংস্কার ঘোষণা করলেও সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নে গভীর ব্যর্থতা দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) সম্প্রতি তাদের প্রতিবেদন ও পর্যবেক্ষণে এ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে দেশের রাজনৈতিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত কঠিন। হাজার হাজার মানুষ ২০২৪ সালে তার স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ শুরু করে। নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ওই আন্দোলনে অন্তত ১,৪০০ জনের প্রাণহানি হয় বলে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে আসে। ওই সহিংসতার প্রতিবাদে অবশেষে শেখ হাসিনা দেশত্যাগে বাধ্য হন।
তবে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর কিছু দমন-পীড়ন কমলেও নিরপেক্ষ ও কাঠামোগত সংস্কার এখনো আনা যায়নি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে গ্রেপ্তার ও অন্যায় আটকের ঘটনা ব্যাপক। দেশজুড়ে গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবাধিকার রক্ষায় কাঠামোগত কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন না হওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা গভীর হচ্ছে।
এইচআরডব্লিউ-এর এশিয়া বিভাগের উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, “যারা গত বছর শেখ হাসিনার দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলন করেছে, তাদের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের স্বপ্ন এখনও পূর্ণ হয়নি। ইউনূসের সরকার নিরাপত্তা বাহিনীর সংস্কার নিয়ে কোনো দৃঢ় পদক্ষেপ নেয়নি এবং সহিংস ধর্মীয় চরমপন্থী গোষ্ঠী ও প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের অধিকারকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না।”
তিনি আরও জানান, ২০২৪ সালে সরকার ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করলেও জাতিসংঘ, দেশি-বিদেশি মানবাধিকার কর্মীদের সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। এর ফলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, রাজনৈতিক সংঘাত ও সাংবাদিকদের প্রতি হয়রানি অব্যাহত রয়েছে।
২০২৪ সালের ২৬ ও ২৭ জুলাই রংপুরের একটি হিন্দু পল্লীতে সহিংস হামলায় কমপক্ষে ১৪টি বাড়িঘর ভাঙচুর হয়। পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে পুলিশের হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা নতুন নয়। ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে ‘ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি’র সমাবেশের সময় সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হন, যা প্রমাণ করে নিরাপত্তা খাতের সংস্কার কতটা জরুরি।
পুলিশ ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯২ হাজার ৪৮৬টি মামলা দায়ের করেছে, যার অধিকাংশই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত। এর মধ্যে অন্তত ১,১৭০ মামলায় সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতাদের নাম রয়েছে, যাদের অনেকেই এখনও অব্যাহতি পাননি। মানবাধিকার সংস্থার হাতে আসা তথ্যে দেখা গেছে, এসব মামলায় অনেক অভিযোগ মিথ্যা এবং অভিযোগপ্রাপ্তদের যথাযথ চিকিৎসা ও জামিনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও মানবাধিকার বিশ্লেষক ড. রুমি চৌধুরী বলেন, “এক বছরেও মৌলিক মানবাধিকার পুনরুদ্ধার হয়নি, যা উদ্বেগজনক। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্তের জন্য গঠিত কমিশন কার্যকর নয়, নিরাপত্তা বাহিনীর সহযোগিতা পাওয়া কঠিন।”
সাংবাদিক নেত্রী আরা রহমান বলেন, “সাংবাদিকদের উপর হয়রানি বন্ধ করা জরুরি। মুক্ত সাংবাদিকতা ছাড়া গণতন্ত্র অটুট থাকে না।”
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জনাথন মিলার বলেন, “বাংলাদেশে ‘স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট’সহ দমনমূলক আইন এখনো প্রয়োগ হচ্ছে, যা বিরোধীদের দমন করতে ব্যবহৃত হয়। সরকারের উচিত এসব আইন সংস্কার করে সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা।”
২০২৪ সালের আগস্টে গঠিত গুম তদন্ত কমিশনে এখন পর্যন্ত ১,৮০০-এর বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। তবে তদন্ত বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কারণ নিরাপত্তা বাহিনী প্রমাণ নষ্ট করছে এবং অভিযুক্ত সদস্যরা সক্রিয়ভাবে তাদের পদে রয়েছেন। কমিটি জানিয়েছে, অনেক সিনিয়র কর্মকর্তা ইতিমধ্যে দেশত্যাগ করেছেন।
এইচআরডব্লিউ দেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে অনুরোধ করেছে:
নির্বিচারে গ্রেপ্তার বন্ধ করতে হবে
বিচারপতি ও নির্বাহী বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে
নিরাপত্তা বাহিনী সংস্কার করতে হবে
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) বিলুপ্ত করতে হবে
নারীর অধিকার ও সংখ্যালঘু সুরক্ষায় অগ্রাধিকার দিতে হবে
মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী নিরাপত্তা সদস্যদের বিচারে সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে
এছাড়া তারা বিদেশি সরকার ও জাতিসংঘকে আহ্বান জানায়, বাংলাদেশের সরকারকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে সমর্থন করতে হবে, কিন্তু একই সঙ্গে যারা মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত তাদের ওপর লক্ষ্যভিত্তিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও আন্তর্জাতিক বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।
মীনাক্ষী গাঙ্গুলি উল্লেখ করেন, “ইউনূস সরকারের সামনে বিশাল চ্যালেঞ্জ রয়েছে। দ্রুত ও বাস্তব সংস্কারের মাধ্যমে যেন বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে প্রকৃত পরিবর্তন আসে, তা নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য দেশের সব রাজনৈতিক দল ও সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।”
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে একটি স্থিতিশীল, মুক্ত ও ন্যায়সঙ্গত পরিবেশ প্রতিষ্ঠার জন্য মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া মজবুত করাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৫ সালে এই সংকট নিরসনের জন্য সুশাসন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দিকে একত্রে কাজ করাই দেশের জন্য অপরিহার্য বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ