
ছবি: সংগৃহীত
স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণকে ঘিরে গঠিত প্রস্তুতি কমিটির উচ্চপর্যায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে বুধবার (৩০ জুলাই)। তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে সকাল ১১টায় আয়োজিত এ সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
সভায় এলডিসি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে গৃহীত মোট ১৬টি সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন অগ্রগতি, চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রতিনিধিরা সভায় তাদের চলমান কার্যক্রম ও অর্জনের তথ্য উপস্থাপন করেন।
সভায় অংশ নেন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টাবৃন্দ, সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন নীতি-নির্ধারক ও বাস্তবায়ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা।
১৬টি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে পাঁচটি সংস্থার অগ্রগতি প্রতিবেদন
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের আয়োজিত এ বৈঠকে জানানো হয়, এলডিসি থেকে উত্তরণের পূর্বশর্ত হিসেবে নির্ধারিত ১৬টি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে পাঁচটি সংস্থা কাজ করছে। এগুলোর মধ্যে—
-
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) : ৪টি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে
-
শিল্প মন্ত্রণালয় : ৩টি সিদ্ধান্ত
-
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) : ২টি সিদ্ধান্ত
-
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় : ৩টি সিদ্ধান্ত
-
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় : ৪টি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে
সভায় এসব সিদ্ধান্তের প্রতিটি বিষয়ে দফায় দফায় বিশ্লেষণ হয় এবং অগ্রগতির পাশাপাশি সীমাবদ্ধতা ও সুপারিশও উঠে আসে।
এনবিআর-এর রিপোর্ট: সিঙ্গেল উইন্ডো বাস্তবায়নে ১৯ সংস্থা যুক্ত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খান সভায় জানান, ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো (NSW) বাস্তবায়নের কাজ অগ্রগতির পথে রয়েছে। এখন পর্যন্ত ১৯টি সরকারি সংস্থা এই ডিজিটাল সিস্টেমে যুক্ত হয়েছে। এতে আমদানি-রপ্তানির প্রক্রিয়াজাতকরণে সময় ও ব্যয় উভয়ই হ্রাস পেয়েছে।
তিনি আরও জানান, ট্যারিফ পলিসি ২০২৩ বাস্তবায়নের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছে এবং ইতোমধ্যে তার বাস্তবায়নও শুরু হয়েছে।
এই পদক্ষেপগুলো দেশের বাণিজ্য ও শিল্পক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে বলে সভায় মত দেন উপস্থিত উপদেষ্টারা।
পোশাক শিল্পের বাইরে নতুন রপ্তানি খাতে সহায়তা বাড়ানোর পরামর্শ
সভায় তৈরি পোশাক শিল্পের বাইরে নতুন রপ্তানি সক্ষমতা গড়ে তোলার দিকেও জোর দেওয়া হয়। বিশেষ করে ম্যান-মেইড ফাইবারভিত্তিক শিল্প এবং এর কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদানের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “শুধু গার্মেন্টসনির্ভরতা দিয়ে উত্তরণ হবে না। আমাদের বিকল্প ও উচ্চমূল্য সংযোজনকারী খাতগুলোকে সমানতালে এগিয়ে নিতে হবে।”
চামড়া শিল্প নিয়ে কঠোর সমালোচনা, আলাদা বৈঠকের নির্দেশ
সভায় চামড়া শিল্প নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বেশ তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেন অধ্যাপক ইউনূস। তিনি বলেন, “দেশের চামড়া শিল্পের ব্যাপারে আমরা অপরাধ করেছি। এর যথাযথ মূল্যায়ন করিনি। অথচ এই শিল্প আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বড় উৎস হতে পারত।”
তিনি বলেন, সাভারে ট্যানারি ভিলেজে স্থাপিত ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি) এখনো পূর্ণমাত্রায় চালু হয়নি। আবার, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় এপিআই পার্ক বাস্তবায়নে ধীরগতিও বড় বাধা হয়ে আছে।
এই সংকট নিরসনে প্রধান উপদেষ্টা চামড়া শিল্পের সংকট নিয়ে একটি পৃথক উচ্চপর্যায়ের বৈঠক আয়োজনের নির্দেশ দেন। এই শিল্পকে বাঁচাতে প্রয়োজনীয় নীতিগত সহায়তা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের ওপর জোর দেন তিনি।
শিল্প নীতি হালনাগাদ ও অকার্যকর নীতির সংস্কার নির্দেশ
২০২২ সালে প্রণীত শিল্প নীতিমালা কতটা কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে, তা নিয়েও সভায় বিশ্লেষণ করা হয়। প্রয়োজনীয় হালনাগাদ, সংশোধন এবং সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা-সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় জোরদারের সুপারিশ করেন উপস্থিতরা।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “যেসব নীতিমালা-আইন কোনো কাজে আসছে না, সেগুলো পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে হবে। দেশের স্বার্থে ও উত্তরণের জন্য এগুলো মৌলিক প্রয়োজন।”
পরবর্তী বৈঠক দুই মাসের মধ্যে, তাগিদ কার্যকর বাস্তবায়নের
সভা শেষে প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা দেন, আগামী দুই মাসের মধ্যেই আবার একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক আয়োজন করা হবে। যেখানে এবারের আলোচনার ভিত্তিতে অগ্রগতি, চ্যালেঞ্জ এবং নতুন দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করা হবে।
তিনি বলেন, “এটা শুধুমাত্র উন্নয়ন নয়, এটা দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি আমাদের দায়িত্ব। আমাদের নিজেদের স্বার্থে এসব কাজগুলো করে যেতে হবে।”
সভায় উপস্থিত ছিলেন:
-
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
-
শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান
-
পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
-
নৌপরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন
-
স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম
-
মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশিদ
-
মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া
-
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খান
-
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর
-
শিল্প, বাণিজ্য, অর্থ এবং পরিবেশ সংশ্লিষ্ট সচিবগণ ও কর্মকর্তা
এই উচ্চপর্যায়ের বৈঠকটি ছিল এলডিসি থেকে উত্তরণ প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এটি দেখায়, বাংলাদেশ শুধু আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সূচকে উত্তরণ নিয়েই নয়, বরং ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক কাঠামোর ভিত্তি তৈরির দিকেও মনোযোগী।
বাংলাবার্তা/এমএইচ