
ছবি: সংগৃহীত
রাষ্ট্রীয় সংস্কার প্রক্রিয়া নিয়ে চলমান আলোচনা এখন একটি নতুন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, যেখানে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের নেতৃত্বে গঠিত এই সংস্কার প্রক্রিয়ার আওতায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার দ্বিতীয় পর্যায় প্রায় শেষ পর্যায়ে এলেও, চূড়ান্ত বাস্তবায়ন নিয়ে স্পষ্ট বিভাজন তৈরি হয়েছে—বিশেষ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর মধ্যে।
ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব ও বিএনপির অবস্থান
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে প্রস্তাব ছিল, সরকার গঠনের পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে আলোচিত সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন করা হবে। এই অবস্থানকে সমর্থন করেছে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ এই প্রক্রিয়াকে ‘ঐতিহাসিক অঙ্গীকারনামা’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেন, এটি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করবে। তিনি বলেন, এই সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনে আইন, সংবিধান ও বিধি পরিবর্তন হবে এবং জাতীয় সংসদই হবে এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের প্রধান ক্ষেত্র।
সালাহউদ্দিন আহমদ জানান, বিএনপি ইতোমধ্যেই ৬টি সংস্কার কমিশনের ৮২৬টি সুপারিশের মধ্যে ৬৫৯টিতে একমত হয়েছে, ৫১টিতে মতবিরোধ এবং ১১৬টিতে দ্বিমত পোষণ করেছে। তার মতে, এই পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে বিএনপি প্রকৃত অর্থেই একটি কার্যকর সংস্কার চায় এবং এই প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছে।
জামায়াত ও এনসিপির সরাসরি বিরোধিতা
অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি এই সংস্কার বাস্তবায়নের সময়সীমা নিয়ে আপত্তি তুলেছে। তাদের অবস্থান—সংস্কারগুলোকে বাস্তবায়নের আগে অবশ্যই আইনি ভিত্তি দিতে হবে, নতুবা এ প্রক্রিয়া কেবল প্রতীকী দলিলে পরিণত হবে। জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, “আইনগত ভিত্তি ছাড়া এই সংস্কার বাস্তবায়ন অসম্ভব। জনগণের কাছে এর কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না।”
তিনি প্রশ্ন তোলেন, “কমিশন যে প্রস্তাব দিয়েছে, তাতে কোথাও বলা হয়নি এই সরকার না থেকে পরবর্তী সরকার বাস্তবায়ন করবে কি না। তাহলে কি বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থেকে দুই বছর সংস্কার বাস্তবায়ন করবে?” এ প্রসঙ্গে তিনি মনে করিয়ে দেন, অতীতেও জিয়াউর রহমান, এরশাদ প্রমুখ শাসক আইনি ভিত্তিতে ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। তাই এখন আইনজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে একটি টেকসই কাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যাতে সংস্কারের বাস্তবতা নিশ্চিত হয়।
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন আরও স্পষ্টভাবে বলেন, “৩৬ জুলাইয়ের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র দিতে হবে এবং তা আইনগত ভিত্তিতে দিতে হবে—এ নিয়ে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না।”
তিনি বলেন, “ঘোষণাপত্র ও সনদ—এই দুটি বিষয় ভিন্ন। সনদে রাষ্ট্র কাঠামোর মৌলিক সংস্কার আর ঘোষণাপত্রে জুলাই আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ। সনদে রাজনৈতিক ঐকমত্যের বিষয়গুলোকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। অন্যথায় এ সনদের কোনো বাস্তব মূল্য থাকবে না এবং এনসিপি তাতে স্বাক্ষর করবে না।”
ঐকমত্যের বিষয় ও আলোচনা
বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান ও আইয়ুব মিয়া। আলোচনা সঞ্চালনা করেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
এদিন আলোচনার ২২তম দিন ছিল, যেখানে ৩০টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়, যার মধ্যে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি ছাড়াও গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ও আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) অন্যতম।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, বৃহস্পতিবারের মধ্যে গ্রহণযোগ্য একটি খসড়া সনদ সব রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানো হবে। এই সনদে সংসদে নারী আসন, সরকারি কর্ম কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, ন্যায়পাল নিয়োগ, রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব, নির্বাচন পদ্ধতি, ইলেকটোরাল কলেজ, সংসদের উচ্চকক্ষ, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণসহ মোট ১৪টি বিষয়ে একমত হওয়া গেছে।
ভিন্নমতের জায়গাগুলো
আলোচনার সময়ে মৌলিক অধিকার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিগত ঐকমত্য থাকলেও, সংবিধানে এই অধিকার সম্প্রসারণের ধরন ও কাঠামো নিয়ে কিছু ভিন্নমত রয়ে গেছে। বিএনপি তাদের সুপারিশ ও আপত্তির তালিকা স্পষ্টভাবে কমিশনের কাছে তুলে ধরেছে, যা আলোচনায় অগ্রগতি আনতে সহায়ক হয়েছে বলে জানান আলী রীয়াজ।
তবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব (অনুচ্ছেদ ৪৮(৩)) এখনো আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে এবং এ বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত প্রস্তাব প্রস্তুত হয়নি।
আইনি ভিত্তির দাবির যৌক্তিকতা
জামায়াত ও এনসিপির অবস্থান আইনগত ভিত্তির প্রশ্নে অনড়। তাদের মতে, আগের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা গেছে, রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আইনগত কাঠামোর অভাব বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। জামায়াত প্রস্তাব দিয়েছে, আইনজ্ঞদের নিয়ে বিশেষ বৈঠক আয়োজন করে খতিয়ে দেখা হোক—কোন পথে আইনগত স্বীকৃতি দেওয়া যেতে পারে।
তাদের মতে, দুই বছরের বাস্তবায়নের প্রস্তাব যদি বর্তমান সরকারের মেয়াদকে নির্দেশ করে, তবে তা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করতে হবে। আর যদি এটি ভবিষ্যতের সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়, তবে সেটি অঙ্গীকারনামার গুরুত্ব হারাবে।
জাতির সামনে চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
এখন প্রশ্ন উঠেছে—জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে অর্জিত এই বৃহৎ রাজনৈতিক সমঝোতা কি বাস্তবে রূপ পাবে? নাকি এটি কেবল একটি প্রতীকী দলিল হিসেবেই রয়ে যাবে?
বিএনপির মতে, এটি একটি ‘সামাজিক চুক্তি’, যা জনগণের সঙ্গে, সমগ্র জাতির সঙ্গে একটি ঐক্যমূলক প্রতিশ্রুতি। তবে জামায়াত ও এনসিপি বলছে, বাস্তবায়নের জন্য এটি যদি সাংবিধানিক বা আইনগত স্বীকৃতি না পায়, তবে এর কোনো বাস্তব মূল্য থাকবে না।
বিশ্লেষকদের মতে, এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, সব রাজনৈতিক শক্তিকে একটি বিশ্বাসযোগ্য রূপকাঠামোর মধ্যে আনা, যাতে আগামী দিনগুলোতে এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের পথ প্রশস্ত হয়।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে এখন প্রধান কাজ হচ্ছে রাজনৈতিক সমঝোতাকে সাংবিধানিক বাস্তবতায় পরিণত করা, যাতে এটিকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যতের সরকার বা দল নিজেদের মত করে সিদ্ধান্ত না নেয়, বরং সবার সম্মিলিত চেষ্টায় একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনা হয়।
এই প্রক্রিয়া যদি সফল হয়, তবে বলা যায়—বাংলাদেশ তার রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি নতুন দিগন্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে এটিও হবে বহু ব্যর্থ উদ্যোগের একটি অংশমাত্র।
বাংলাবার্তা/এসজে