
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজনীতিতে নতুন এক মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে “জুলাই সনদ”। রাজনৈতিক সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আগামী বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) এর মধ্যেই সনদটি চূড়ান্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এর আগে, বুধবার (৩০ জুলাই) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপে বসে কমিশন। ঐ বৈঠকে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতেই সনদের চূড়ান্ত রূপরেখা নির্ধারিত হবে বলে জানানো হয়েছে।
কমিশনের একটি উচ্চপর্যায়ের সূত্র জানায়, জুলাই মাসেই সনদের খসড়া দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছিল। এ খসড়ায় ২০টি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব রাখা হয়, যার মধ্যে ১২টি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নীতিগত ঐকমত্য অর্জিত হয়েছে। তবে বাকি ৮টি বিষয়ে এখনো মতপার্থক্য থাকায় এগুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। সংলাপের মাধ্যমে বৃহস্পতিবারের মধ্যে ওই সব বিষয়ে সমঝোতা গড়ে তুলে চূড়ান্ত সনদ অনুমোদন ও প্রকাশ করতে চায় কমিশন।
কমিশন বলছে, নতুন সরকার নির্বাচিত হলে ওই সরকারকে এই সনদ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে, নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আসার প্রথম দুই বছরের মধ্যেই জুলাই সনদে উল্লিখিত সংস্কার বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
বুধবারের সংলাপে আলোচনা হয় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে। তার মধ্যে রয়েছে—
সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি
রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব ও ক্ষমতা পুনর্বিন্যাস (সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৮(৩))
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি ও ইলেক্টোরাল কলেজ প্রবর্তনের প্রস্তাব
উচ্চকক্ষ বা দ্বিতীয় কক্ষ গঠন ও সদস্য মনোনয়ন প্রক্রিয়া
রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো ও নীতিমালার সংস্কার
নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ
এই আলোচনার মাধ্যমে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, দায়িত্বশীল ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের নীতিগত ভিত্তি তৈরি করতে চায় ঐকমত্য কমিশন।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের মার্চ থেকে মে পর্যন্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, পেশাজীবী সংগঠন এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে ১৬৬টি সুপারিশ গ্রহণ করে কমিশন। এরপর জুন থেকে তা বিশ্লেষণ ও পরিমার্জন করে ২০টি মৌলিক বিষয়ে রূপান্তর করা হয়, যার ওপর ভিত্তি করেই বর্তমান সংলাপ চলছে।
কমিশনের এক সদস্য জানান, “আমরা চাই একটি জাতীয় ঐকমত্য তৈরি হোক। সেই লক্ষ্যেই দীর্ঘ সময় ধরে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে অনেকগুলো বিষয়ে মতৈক্য এসেছে, বাকিগুলোতেও আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হবে বলে আমরা আশাবাদী।”
দলগুলোর মধ্যে যেসব বিষয়ে পূর্ণ ঐকমত্য তৈরি হয়নি, সেই সব বিষয়ে তারা “নোট অব ডিসেন্ট” বা ভিন্নমত সংযুক্ত করার সুযোগ পাচ্ছে। কমিশন বলছে, চূড়ান্ত সনদে এসব ভিন্নমতের বিষয়গুলোও প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ থাকবে, যেন ভবিষ্যতে এ নিয়ে আলাপ-আলোচনার সুযোগ উন্মুক্ত থাকে।
জুলাই সনদকে কেন্দ্র করে যে নতুন ধরনের রাজনৈতিক কাঠামো গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তা একদিকে যেমন রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংস্কারে দিকনির্দেশনা দেবে, অন্যদিকে জনগণের প্রত্যাশাও প্রতিফলিত হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, “এই সনদ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য দূর করে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও দায়বদ্ধ রাজনীতির ভিত্তি গঠনে সহায়ক হবে। তবে বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সামাজিক চাপে পরিণত হওয়া দরকার।”
৩১ জুলাইয়ের মধ্যে চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়ার পরই ঐকমত্য সনদের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ও গেজেট প্রকাশ করা হবে। পরে তা দেশের সব রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন এবং আগামী নির্বাচনের প্রার্থীদের কাছে পাঠানো হবে। এছাড়া, সনদের বাস্তবায়ন ও অগ্রগতি মূল্যায়নের জন্য একটি মনিটরিং সেল গঠন করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন কমিশনের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।
এখন দেখার বিষয়—বৃহস্পতিবারের বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাকি ৮টি বিষয়েও সম্মিলিত সিদ্ধান্ত আসবে কি না। যদি আসে, তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই জুলাই সনদ হতে পারে একটি যুগান্তকারী দলিল।
বাংলাবার্তা/এমএইচ