
ছবি: সংগৃহীত
আজ বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথমার্ধের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে। বিকেল ৩টায় ঢাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এই মুদ্রানীতির রূপরেখা তুলে ধরবেন। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা, মূল্যস্ফীতি, ঋণপ্রবাহ ও বিনিয়োগ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এবারের মুদ্রানীতি কেমন হতে পারে, তা নিয়ে অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে তীব্র আগ্রহ বিরাজ করছে।
গত এক বছর ধরেই বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে ধারাবাহিকভাবে কঠোর, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির পথ অবলম্বন করে আসছে। ২০২৪ সালের ২৭ অক্টোবর থেকে নীতিসূদহার ১০ শতাংশে নির্ধারণ করা হয়, যা এখনো বলবৎ আছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ সুদহারে, যা কিছু ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত উঠে গেছে।
এই উচ্চ সুদের কারণে শিল্প, উৎপাদন ও ব্যবসা খাতে নতুন বিনিয়োগের গতি কমেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। একই সঙ্গে পুরনো ঋণের কিস্তি পরিশোধেও তৈরি হয়েছে চাপ। ফলে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে, যা আবার পুরো আর্থিক খাতের ওপর দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি তৈরি করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, কঠোর নীতির ফলে মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশ থেকে এক বছর শেষে ৭ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। তবে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে মূল্য দিতে হয়েছে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের ঘাটতিতে। বর্তমানে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৭ শতাংশেরও নিচে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব লক্ষ্যমাত্রা থেকে ৩ দশমিক ১ শতাংশ কম।
এই প্রেক্ষাপটে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা মুদ্রানীতিকে আরও বিনিয়োগবান্ধব করার আহ্বান জানিয়েছেন। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, "বর্তমান সুদহার ব্যবসার জন্য অত্যন্ত প্রতিকূল। অনেকেই নতুন বিনিয়োগ তো দূরের কথা, পুরনো ঋণের কিস্তি দিতেই হিমশিম খাচ্ছেন। এর ফলে খেলাপি ঋণ বাড়ছে এবং অর্থনীতি চাপে পড়ছে।"
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, দীর্ঘদিন ধরে সংকোচনমুখী নীতি বজায় রাখলে মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হলেও সামগ্রিক অর্থনৈতিক গতি হারিয়ে ফেলতে পারে। ড. মাহফুজ কবিরের মতে, “আমাদের এখন একসঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও উৎপাদন বাড়ানোর পথ খুঁজতে হবে। উৎপাদন বাড়াতে চাইলে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিনিয়োগ বাড়াতে চাইলে ঋণের সুদহার সহনীয় মাত্রায় আনতে হবে।”
তিনি সুপারিশ করেন, স্ট্যান্ডার্ড ঋণসুবিধার হার, যা বর্তমানে ১১.৫ শতাংশে রয়েছে, তা কমিয়ে ১০.৫ শতাংশে আনা হলে ধাপে ধাপে ব্যাংক ঋণের সুদও কমে আসবে এবং ব্যবসায়ী শ্রেণি স্বস্তি পাবে।
নতুন মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ধীরে ধীরে সংকোচনমুখী নীতি থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান জানিয়েছেন, “আমরা ডিসেম্বর পর্যন্ত কিছুটা সংকোচনমুখী অবস্থানে থাকতে চাই, যাতে মূল্যস্ফীতিকে আরও নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। তবে দীর্ঘমেয়াদে আমরা বিনিয়োগবান্ধব শিথিল নীতির দিকে যেতে চাই। আমাদের লক্ষ্য এখন বিনিয়োগ বাড়ানো।”
তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ চাঙ্গা হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রত্যাশা। “বর্তমানে নির্বাচনের অনিশ্চয়তা থাকায় বিনিয়োগকারীরা অপেক্ষা করছে। কিন্তু তফসিল ঘোষণার পর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হলে বিনিয়োগের প্রবাহ বাড়বে, যা অর্থনীতিকে গতিশীল করবে।”
ভোক্তা ব্যয়ের নিম্নগতি ও ডলার সংকট সামাল দিতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানিতে কড়া নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিল। তবে এখন মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমায় এবং রিজার্ভ সামান্য স্বাভাবিক হওয়ায় আমদানি নিয়ন্ত্রণ কিছুটা শিথিল করার ভাবনায় রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিতে কিছুটা স্বস্তি আসবে বলে আশা করছেন উদ্যোক্তারা।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসার কারণে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং বিনিয়োগে দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও একই মত প্রকাশ করেছে। তাদের মতে, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে, যা অর্থনীতিকে আবার সচল করার পথ দেখাবে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি হতে যাচ্ছে একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতি, যেখানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সংকোচন থেকে শিথিলতায় ধীরে ধীরে যাত্রা করার মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একধরনের ‘ট্রানজিশনাল মুদ্রানীতির’ পথে হাঁটছে—যেখানে দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতির পুনর্জাগরণই মুখ্য লক্ষ্য।
আজকের ঘোষণায় সুদহার, স্ট্যান্ডার্ড ঋণসুবিধা, মুদ্রাস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা ও বেসরকারি ঋণপ্রবাহ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী বার্তা দেয়, তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবে অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট মহল।
বাংলাবার্তা/এমএইচ