
ছবি: সংগৃহীত
পুঁজিবাজারে গুরুতর অনিয়ম, স্বার্থবিরোধী কার্যক্রম এবং বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির দায়ে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা এবং আইএফআইসি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানকে আজীবনের জন্য পুঁজিবাজারে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। একইসঙ্গে তাকে ১০০ কোটি টাকা আর্থিক জরিমানা গুণতে হবে।
এছাড়া তার ছেলে এবং আইএফআইসি ব্যাংকের সাবেক ভাইস-চেয়ারম্যান আহমেদ শায়ান ফজলুর রহমানকেও আজীবনের জন্য পুঁজিবাজারে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং তার ওপর ৫০ কোটি টাকা জরিমানা আরোপ করা হয়েছে।
বুধবার (৩০ জুলাই) বিএসইসির ৯৬৫তম কমিশন সভায় এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন কমিশনের চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। সভা শেষে বিএসইসির পক্ষ থেকে জানানো হয়, দীর্ঘদিন ধরেই পুঁজিবাজারে শৃঙ্খলা ভঙ্গ, স্বার্থের সংঘাত, অস্বচ্ছ বিনিয়োগ নীতি এবং নিরীক্ষা এড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিগ্রস্ত করার মতো গুরুতর অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
কমিশন জানায়, তদন্তে দেখা গেছে—আইএফআইসি ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরা ২০২১-২২ অর্থবছরে নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান আইএফআইসি ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেডের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে বড় অঙ্কের অর্থ প্রবাহিত করেছেন, যেখানে সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান মানা হয়নি। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (অন্তর্ভুক্তি, বেনিফিশিয়ারি ওনার অ্যাকাউন্ট, স্টক ব্রোকার কার্যক্রম, প্রাঃ লি. কোম্পানির সুশাসন) বিধিমালাসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট আইন লঙ্ঘন হয়েছে।
তদন্তে আরও জানা গেছে, কিছু শেয়ারের অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধি এবং ট্রেডিং ঘনত্ব বৃদ্ধির পেছনে উক্ত কর্মকর্তাদের প্রভাবশালী ভূমিকা ছিল। এগুলোর প্রেক্ষিতে বাজারে কৃত্রিম চাহিদা তৈরি হয়, যা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ভুল সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে।
শুধু সালমান এফ রহমান ও তার ছেলেই নন, এই অনিয়মের জাল ছড়িয়ে রয়েছে আরও অনেকের মধ্যে। বিএসইসি আরও জানায়—
আইএফআইসি ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেডের তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইমরান আহমেদকে পাঁচ বছরের জন্য পুঁজিবাজার থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
আইএফআইসি ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ আলম সারওয়ারের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
প্রতিষ্ঠান হিসেবেও আইএফআইসি ব্যাংক পিএলসিকে সতর্ক করা হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে এরকম অনিয়ম আর না ঘটে।
কমিশন আরও জানায়, এই ঘটনায় সংশ্লিষ্টতা থাকায় এবং যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন না করায় আইএফআইসি ব্যাংকের তৎকালীন মনোনীত পরিচালক এ আর এম নাজমুস সাকিব, মো. গোলাম মোস্তফা, মো. জাফর ইকবাল (এনডিসি), কাওমরুন নাহার আহমেদ এবং তৎকালীন স্বতন্ত্র পরিচালক সুধাংশু শেখর বিশ্বাসকেও সতর্ক করা হয়েছে।
বিএসইসির পক্ষ থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, “পুঁজিবাজারে স্বচ্ছতা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে কমিশন কঠোর অবস্থানে রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।” এই সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
সালমান এফ রহমান দেশের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, বেক্সিমকো গ্রুপের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা। তার মতো একজন উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিএসইসির এই সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে যে, সরকার এখন শীর্ষপর্যায়ের অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে পিছপা হচ্ছে না।
অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, পুঁজিবাজারে যদি আইনগত শাসন ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে। বিএসইসির এই পদক্ষেপ এক্ষেত্রে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করল।
সাবেক ব্যাংক চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা, পরিবারের সদস্য, পরিচালক—সবার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য এবং কার্যকর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন যে একটি বার্তা দিতে চেয়েছে, তা স্পষ্ট। পুঁজিবাজার আর শুধুই প্রভাবশালীদের খেলার মাঠ থাকবে না—এমনটাই আশা করছেন বিনিয়োগকারীরা।
এখন দেখার বিষয়, আইএফআইসি ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে যান কিনা। তবে বাজারে ইতোমধ্যেই এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারী ও বিশ্লেষক মহল।
এই সিদ্ধান্ত বাজারে দীর্ঘদিনের ‘দায়মুক্তির সংস্কৃতি’র বিরুদ্ধে এক বড় ধাক্কা—এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ