
ছবি: সংগৃহীত
তীব্র খাদ্য সংকটে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা। একসময় প্রাণবন্ত ঘরবাড়ি, ব্যস্ত বাজার, শিশুদের কলতানে মুখরিত গলিপথ—সবকিছুই এখন নিঃস্তব্ধ। যুদ্ধ ও অবরোধের কারণে গাজা আজ এক মৃত্যুকূপ, যেখানে প্রতিটি ঘরে ক্ষুধা আর কান্না। খাবারের হাহাকার এখন জীবনের একমাত্র বাস্তবতা। মানুষ আর মানুষের মতো বেঁচে নেই, বাঁচার সংগ্রামে তারা ময়লার ভাগাড়েও মুখ গুঁজতে বাধ্য হচ্ছে—সেখানে যদি মেলে কিছু খাওয়ার মতো। এই মানবিক বিপর্যয়ের ছবি প্রতিনিয়ত তুলে আনছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ও সাহায্য সংস্থাগুলোর রিপোর্ট। গাজার আকাশজুড়ে শুধু ধোঁয়া নয়, ছড়িয়ে পড়েছে অনাহারের দীর্ঘশ্বাস।
আল জাজিরার বরাতে জানা গেছে, গাজার এমন অনেক পরিবার আছে যারা দিনের পর দিন খাবার না পেয়ে বাধ্য হয়ে শহরের আবর্জনার স্তূপে ছুটে যাচ্ছেন। বয়স্ক, নারী, এমনকি শিশুরাও আশায় থাকছে—ময়লার মধ্যে হয়তো পাওয়া যাবে অর্ধেক খাওয়া কোনো ফল বা বাসি কোনো রুটি। চোখের সামনে যখন সন্তান ক্ষুধায় কাঁদে, তখন এক মা কিংবা বাবার কাছে ময়লার ভাগাড়ও হয়ে ওঠে সম্ভাব্য রসদভাণ্ডার।
একজন বাসিন্দা বলেন, “আমার তিন সন্তান। গত দুই দিন ধরে তাদের জন্য কিছুই জোগাড় করতে পারিনি। বাধ্য হয়ে আমি ভাগাড়ে যাই। কোনোদিন কিছু পাই, কোনোদিন কিছুই না।”
এই দৃশ্যগুলো শুধু দারিদ্র্যের নয়, বরং এটি গোটা এক জাতির বিরুদ্ধে পরিচালিত অব্যাহত অবরোধ ও সামরিক আগ্রাসনের প্রতিচ্ছবি।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ৩১ জুলাই বুধবার অনাহারে আরও সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫৪ জনে, যার মধ্যে অন্তত ৮৯ জনই শিশু। প্রতিদিনই কোনো না কোনো পরিবারে নিভে যাচ্ছে নতুন একটি জীবন। শিশুরা যে শুধু ক্ষুধার শিকার হচ্ছে তা নয়, তারা মারাত্মক পুষ্টিহীনতাও বয়ে বেড়াচ্ছে।
আন্তর্জাতিক খাদ্য নিরাপত্তা সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি) তাদের সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে জানিয়েছে, গাজার অধিকাংশ অঞ্চল এখন “দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে” অবস্থান করছে।
এপ্রিল মাস থেকে এ পর্যন্ত গাজায় প্রায় ২০ হাজারেরও বেশি শিশু মারাত্মক পুষ্টিহীনতায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। শুধু ১৭ জুলাই থেকে ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে অন্তত ১৬ জন পাঁচ বছরের নিচের শিশু মারা গেছে শুধুমাত্র ক্ষুধার কারণে। ৩ হাজারের মতো শিশুর জীবন এখনো ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
ক্ষুধার থাবা শুধু শিশুদের নয়, নারীদের ওপরও ভয়াবহভাবে পড়েছে। গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারীদের মধ্যে ২৫ শতাংশের বেশি মারাত্মক পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন, যা আগের মাসের তুলনায় ১৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে প্রসবকালীন জটিলতা, মৃত শিশু জন্ম এবং মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকিও বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে।
গাজা ও পশ্চিম তীর মিলিয়ে মোট জনসংখ্যা প্রায় ৫.২ মিলিয়ন। এর মধ্যে ১.৪ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ এখন তীব্র খাদ্যসংকটে ভুগছেন। প্রতিদিন খাবারের সংস্থান একটি চ্যালেঞ্জ। বাজারগুলোয় যেটুকু খাদ্যসামগ্রী পাওয়া যায়, তার দাম এত বেশি যে সাধারণ মানুষ তা কেনার ক্ষমতা রাখে না। ফলে খাবার আছে, কিন্তু সেটা নাগালের বাইরে।
যেসব পরিবার কিছুদিন আগেও নিজেদের অল্প আয় দিয়েই সংসার চালাতো, তারাও এখন মানবেতর জীবনযাপন করছে। একবেলার খাবার জোগাড় করতেই হিমশিম খাচ্ছে সবাই। ফলে কেউ কেউ বাধ্য হয়ে সন্তানদের না খাইয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে, কেউবা খাবারের আশায় বিক্ষোভেও নামছেন।
গাজার মানবিক পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা একে “ম্যাড ইন ফ্যামিন” বা মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ বলে আখ্যা দিয়েছে।
জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফ জানিয়েছে, গাজার শিশুদের জীবনরক্ষা এখন সময়ের সবচেয়ে বড় জরুরি চ্যালেঞ্জ। তারা বলেছে—এই সংকট শুধু খাদ্য সরবরাহ করলেই সমাধান হবে না; প্রয়োজন স্থায়ীভাবে অবরোধ প্রত্যাহার, নিরবিচ্ছিন্ন ত্রাণ প্রবেশ, এবং মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করা।
গাজায় আজ মানুষের চোখে শুধু আতঙ্ক নয়, ক্ষুধার কান্না। শিশুদের মুখে হাসি নেই, শুধু অনাহারের ছাপ। যখন বিশ্ব উন্নয়নের নানা গল্পে মত্ত, তখন গাজার শিশুরা ক্ষুধার যন্ত্রণায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে।
এই অবস্থা চলতে থাকলে গাজায় বহু প্রাণ অকালে ঝরে যাবে, যা মানবতার বিরুদ্ধে এক নিঃশব্দ গণহত্যার নামান্তর। বিশ্ব বিবেক যদি এখনই জাগ্রত না হয়, তবে এই ক্ষুধার্ত কান্না আরও অনেক মৃত্যু সংবাদ বয়ে আনবে। এখনই গাজার জন্য প্রয়োজন অবরোধমুক্ত নিরবিচ্ছিন্ন খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা। তা না হলে ইতিহাস এক ভয়াবহ মানবিক ব্যর্থতার সাক্ষী হয়ে থাকবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ