
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, দেশের চলমান মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রেখে সেটিকে আগামী দিনগুলোতে ৩ শতাংশের মতো সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথমার্ধ (জুলাই-ডিসেম্বর) সময়ের জন্য নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই অভিমত প্রকাশ করেন।
প্রেস ব্রিফিংয়ে গভর্নর বলেন, "গত কয়েক মাসে মূল্যস্ফীতির কিছুটা নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা গেছে। জানুয়ারির পর থেকে টেকসইভাবে মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করেছে। আমরা চাই সেটি আরও কমুক এবং অবশেষে এমন এক পর্যায়ে নামুক যা দেশের ভোক্তাদের জন্য স্বস্তিদায়ক হয়। আমাদের লক্ষ্য মূল্যস্ফীতিকে ৩ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনা। তবে এটা কোনো রাতারাতি ব্যাপার নয়—এটি সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া।"
তিনি আরও বলেন, "মূল্যস্ফীতির ওপর যে চাপ রয়েছে, সেটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য ওঠানামা, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ সরবরাহ ব্যবস্থা এবং মুদ্রানীতির কড়াকড়ি—এই সবকিছুর সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। আমরা ধাপে ধাপে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে কাজ করে যাচ্ছি।"
নতুন মুদ্রানীতিতে নীতিসুদ (Policy Rate) আগের মতো ১০ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যে হারে ঋণ নিতে পারে, সে হার অপরিবর্তিত থাকবে। এতে করে অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বাজারে মুদ্রার প্রবাহ নিয়ন্ত্রিত রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান গভর্নর।
তিনি বলেন, "আমরা চাই নীতিসুদের কাঠামো এমনভাবে স্থির থাকুক, যাতে একদিকে মূল্যস্ফীতিকে লাগাম দেওয়া যায় এবং অন্যদিকে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে। একই সঙ্গে আমরা আশা করছি, ডিসেম্বরের মধ্যে ব্যাংকগুলোর লেন্ডিং রেট (ঋণের সুদহার) ও ডিপোজিট রেট (আমানতের সুদহার) ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। এ লক্ষ্যেই ব্যাংকিং খাতকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।"
গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর স্বীকার করেন, বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ কারণে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ অনেক বেশি। খাদ্যপণ্যের মূল্য, জ্বালানি খাত, আমদানি ব্যয় এবং ডলারের বিনিময় হার—এই চারটি বিষয় মূল্যস্ফীতিকে প্রভাবিত করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, “যদিও সাম্প্রতিক মাসগুলোতে কিছুটা স্থিতিশীলতা এসেছে, তারপরও বাজারে আস্থার ঘাটতি রয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যাংকিং খাত একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আমরা চাই ব্যাংকগুলো বিনিয়োগে উৎসাহ দেবে, তবে দায়িত্বশীল এবং পরিমিত হারে। আমদানি ব্যয়, এলসি খোলা ও বিদেশি মুদ্রা লেনদেনের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা বজায় রাখা হবে।”
মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে, টাকার মানকে বাজারভিত্তিক রাখার কৌশল বজায় থাকবে। ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় হার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক হস্তক্ষেপ করবে না, বরং বাজার নির্ধারিত হার অনুসরণ করবে। তবে প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে হস্তক্ষেপ করে স্থিতিশীলতা রক্ষা করবে বলেও জানান গভর্নর।
রিজার্ভ পরিস্থিতি নিয়েও আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, “আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে কিছুটা চাপ আছে, তবে এটি বড় কোনো সংকট নয়। একদিকে রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় বাড়ানো, অন্যদিকে অপ্রয়োজনীয় আমদানি কমানোর মাধ্যমে রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্য রক্ষা করা হচ্ছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জানান, আগামী মাসগুলোতে তারা ধারাবাহিকভাবে মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাস্ফীতি দুই নিয়ন্ত্রণেই নজর রাখবেন। নগদ প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার, বৈদেশিক লেনদেনে স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ এবং টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন—এই চারটি বিষয়ে জোর দেওয়া হবে।
সব মিলিয়ে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে এনে সাধারণ জনগণের ওপর অর্থনৈতিক চাপ কমানো এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করাই বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল লক্ষ্য বলে জানান গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর।
বাংলাবার্তা/এমএইচ