
ছবি: সংগৃহীত
বর্তমান বাংলাদেশের নগরজীবনে সবচেয়ে আলোচিত এবং উদ্বেগজনক এক সামাজিক সংকটের নাম হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহর ও উপজেলা পর্যায়ে অপ্রতিরোধ্য গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে কিশোর অপরাধচক্র। তারা শুধু ছিনতাই বা মারামারিতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং চাঁদাবাজি, মাদক বেচাকেনা, দখলদারি, এমনকি খুনখারাবির মতো অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে।
সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, কিশোর গ্যাং অপরাধ এখন আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং এটি একটি বিস্তৃত সামাজিক বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে, যা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিশেষত, গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয়তা কিংবা ধীর প্রতিক্রিয়া পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
বর্তমানে পাড়া-মহল্লায় দেশীয় অস্ত্র হাতে প্রকাশ্যে মহড়া, গ্রুপ সংঘর্ষ, হুমকি-ধমকি এবং নিরীহ নাগরিকদের উপর হামলা চালানো যেন নিয়মিত চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদল কিশোর অপরাধী অন্য দলের বিরুদ্ধে এলাকাভিত্তিক আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে ভয়ংকর সংঘাতে জড়াচ্ছে। স্থানীয় লোকজন এমনকি শিক্ষার্থীরাও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। পুলিশ কিংবা স্থানীয় প্রশাসনকে জানানো হলেও অনেকক্ষেত্রে প্রতিকার মিলছে না।
২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হালনাগাদ এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, সারা দেশে অন্তত ২৩৭টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। শুধু রাজধানী ঢাকাতেই আছে ১২৭টি গ্যাং, যেখানে প্রায় ১ হাজার ৩৮২ জন কিশোর জড়িত। চট্টগ্রাম শহরে আছে ৫৭টি গ্যাং, সদস্য সংখ্যা ৩১৬ জন। অথচ এর আগের ২০২২ সালের ডিএমপি প্রতিবেদনে সারা দেশে গ্যাংয়ের সংখ্যা ছিল ১৭৩টি। গত এক বছরের মধ্যে এই সংখ্যা দ্বিগুণের কাছাকাছি পৌঁছেছে, যা কিশোর অপরাধ প্রবণতার ভয়াবহ বিস্তার নির্দেশ করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হাসান এ শাফী এই কিশোর অপরাধ প্রবণতার পেছনে গভীর সমাজতাত্ত্বিক কারণ চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেন, এই কিশোররা সাধারণত এমন সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বড় হয়, যেখানে নেই মানসম্পন্ন শিক্ষা, নেই স্বাস্থ্যসেবা, নেই সামাজিক স্বীকৃতি এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ। ফলে তারা এক ধরনের আত্মপরিচয়ের সংকটে পড়ে। তখন গ্যাং সংস্কৃতি তাদের কাছে হয়ে ওঠে সম্মান ও ক্ষমতার প্রতীক।
এছাড়া ইন্টারনেট, ভিডিও গেমস, র্যাপ মিউজিক, সহিংসতাপূর্ণ অনলাইন কনটেন্ট—সব মিলে এক ধরনের বিকল্প জগত তৈরি হয় কিশোরদের জন্য, যা তাদের বাস্তব জীবনের হতাশা থেকে সরে গিয়ে গ্যাং সংস্কৃতিতে আশ্রয় নিতে উদ্বুদ্ধ করে।
তিনি আরও বলেন, দুর্বল পারিবারিক বন্ধন, বাবা-মার সঙ্গে আবেগগত দূরত্ব এবং সামাজিক একাকীত্ব কিশোরদেরকে গ্যাং সংস্কৃতির দিকে ঠেলে দেয়। গ্যাংয়ের সদস্যরা সেখানে বন্ধুত্ব, আনুগত্য, আর্থিক সহায়তা এমনকি আবেগগত নিরাপত্তা খুঁজে পায়।
কিশোর গ্যাং সমস্যাকে আরেকটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক। তার মতে, এ দেশে রাজনীতির সঙ্গে অপরাধের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। রাজনৈতিক দলগুলো অনেক সময় নিজেদের স্বার্থে এসব কিশোর গ্যাংকে ব্যবহার করে। তাদের মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণ, প্রতিপক্ষকে ভয় দেখানো বা সন্ত্রাসী কাজ করানোতে কিশোর গ্যাংকে মোবিলাইজ করা হয়।
তিনি বলেন, ‘রাজনীতির অপরাধীকরণ এবং অপরাধের রাজনীতিকরণ’ এখন পরস্পরের সম্পূরক। যখন ক্ষমতার পরিবর্তন হয়, তখন কেবল দলের রঙ বদলায়, কিন্তু গ্যাং রয়ে যায়। ফলে এক ধরনের দীর্ঘস্থায়ী পৃষ্ঠপোষকতা পায় কিশোর অপরাধীরা, যেটি তাদের অপরাধে উদ্বুদ্ধ করে এবং আইনের ভয় দূর করে দেয়।
কিশোর অপরাধের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, কিশোরদের মাঝে ধৈর্য ও সহনশীলতার অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। শারীরিক খেলাধুলার জায়গাগুলোর অভাব, পারিবারিক অনুশাসনের দুর্বলতা, ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব এবং মিডিয়া আসক্তি—এসব মিলে তারা বাস্তব জগৎ থেকে এক ধরনের সরে দাঁড়ানো অনুভব করে।
তিনি বলেন, অনেক কিশোরের মধ্যে ‘কন্ডাক্ট ডিজঅর্ডার’ নামক মানসিক সমস্যা লক্ষ্য করা যায়, যার ফলে তারা নিয়ম-কানুন, সামাজিক শৃঙ্খলা মানতে চায় না।
অধ্যাপক হাসান এ শাফীর মতে, কিশোর গ্যাং কোনো একটি শ্রেণির সমস্যা নয়, এটি একটি সামগ্রিক সামাজিক কাঠামোর প্রতিফলন। আমাদের অতীতে ক্লাব, নাট্যদল, খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন তরুণদের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। আজ সেগুলো প্রায় বিলুপ্ত। ফলে কিশোররা নিঃসঙ্গ ও লক্ষ্যহীন হয়ে পড়ছে।
ড. তৌহিদুল হক বলেন, রাষ্ট্রকে কেবল প্রতিক্রিয়াশীল নীতি থেকে বের হয়ে এসে প্রো-অ্যাক্টিভ ভূমিকা নিতে হবে। সমাজের সব স্তরের কিশোরদের জন্য কর্মমুখী শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং মানসিক বিকাশের সুযোগ তৈরি করতে হবে। তা না হলে কয়েক বছর পর এই কিশোর গ্যাং একটি বৃহৎ সশস্ত্র সন্ত্রাসী শক্তিতে পরিণত হবে, যা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
ডা. হেলাল উদ্দিন মনে করেন, কিশোর অপরাধীদের শুধু অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করলেই হবে না। বরং তাদের সংশোধনের সুযোগ দিতে হবে। এজন্য পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রের যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন। পরিবারে বাবা-মাকে কিশোরদের সময় দিতে হবে, স্কুলে শিক্ষার্থীদের মনোভাব পরিবর্তনের জন্য মানবিক শিক্ষা দিতে হবে, আর রাষ্ট্রকে সংশোধনাগারগুলোকে শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত করতে হবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, পুলিশ কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে সজাগ রয়েছে। অভিযোগ পেলেই অভিযান পরিচালনা করে তাদের আইনের আওতায় আনা হয়। তবে বিষয়টি শুধুমাত্র পুলিশের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্মিলিত উদ্যোগেই এ সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব।
কিশোর গ্যাং এখন একটি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি। এটি আর শুধু আইনশৃঙ্খলার সমস্যা নয়, এটি একটি গভীর সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক সংকট। যার সমাধান কেবল শাস্তি দিয়ে নয়—সমন্বিত, মানবিক ও দূরদর্শী পরিকল্পনার মাধ্যমে সম্ভব। আর সে পরিকল্পনার কেন্দ্রে থাকতে হবে মানবিক সমাজ গঠন, তরুণদের ক্ষমতায়ন ও সুস্থ বিনোদনের সুযোগ নিশ্চিতকরণ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ