
ছবি: সংগৃহীত
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সম্প্রতি দাবি করেছেন, গাজা উপত্যকায় "কেউ অনাহারে নেই", এমনকি সেখানে মানবিক সহায়তার প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে না। এই মন্তব্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে, বিশেষ করে যখন জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংস্থা এবং বিশ্বের শীর্ষ নেতারা একযোগে গাজার মানবিক পরিস্থিতিকে 'ভয়াবহ' এবং 'ব্যাপক দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে' বলে বর্ণনা করছেন।
নেতানিয়াহু আরও বলেন, “আমাদের এমন কোনো নীতি নেই যাতে গাজাবাসীদের অনাহারে রাখা হয়। যুদ্ধের সময়ও আমরা মানবিক সহায়তা প্রবেশ করতে দিয়েছি। না দিলে গাজায় এখন কোনো মানুষই থাকত না।” এই বক্তব্যে ইসরাইলের ‘নৈতিক অবস্থান’ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হলেও, বাস্তব চিত্র ভিন্ন কিছু বলছে।
নেতানিয়াহুর এই বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্তমানে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেন, “গাজার যে শিশুদের ছবি দেখেছি, তারা খুবই ক্ষুধার্ত দেখাচ্ছে। তাদের মুখের দিকে তাকালে বোঝা যায় তারা দিনের পর দিন খাবার পায়নি।”
ট্রাম্পের এই বক্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ কারণ ইসরাইলের দীর্ঘদিনের মিত্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা সাধারণত ইসরাইলপন্থী অবস্থান নিয়ে থাকেন। তবে বর্তমানে গাজা পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, তা অস্বীকার করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সম্প্রতি ইসরাইল ঘোষণা দেয়, তারা সপ্তাহান্তে গাজায় মানবিক বিরতি দেবে এবং আকাশপথে ত্রাণ সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হবে। এ পদক্ষেপের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের ভূমিকা রয়েছে।
তবে গাজার অধিবাসীরা বলছেন, এই ঘোষণার বাস্তব প্রতিফলন খুবই সীমিত। দোহা থেকে প্রকাশিত আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, “যেখানে ১০০টি ট্রাক প্রয়োজন, সেখানে ঢুকছে মাত্র ৫টি—এত কম ত্রাণ দিয়ে কিছুই হয় না।”
জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থার তথ্য: দুর্ভিক্ষে মৃত্যু আসন্ন
জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর জানিয়েছে, গাজার উত্তরাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে শিশুদের অপুষ্টিজনিত মৃত্যুর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। কিছু এলাকায় খাদ্যের সংকট এতটাই প্রকট যে, পরিবারগুলো পাখি, ঘাস এবং পশু খাদ্য খেতে বাধ্য হচ্ছে।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (WFP) বলছে, “গাজায় দুর্ভিক্ষ এখন আর ঝুঁকি নয়, এটি বাস্তব। আমরা প্রতিদিনই দেখতে পাচ্ছি শিশুদের অপুষ্টি, মা-বাবার আর্তনাদ, এবং খাদ্যহীন অবস্থায় দীর্ঘদিন কাটানোর প্রমাণ।”
ইসরাইলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, “হামাস সদস্যরা ত্রাণ লুট করে নিজেদের সংগ্রহে রাখছে এবং সেগুলো নিজেদের শাসনব্যবস্থা মজবুত করতে ব্যবহার করছে।”
তবে এ অভিযোগের পক্ষে কোনও নির্ভরযোগ্য প্রমাণ ইসরাইল এখনও উপস্থাপন করতে পারেনি। বরং জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক রেড ক্রস জানিয়েছে, তারা এ ধরনের কোনো বিস্তৃত লুটপাটের ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেনি।
জাতিসংঘের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সমন্বয়ক লিন হেস্টিংস বলেন, “যথাযথ পরিমাণে ত্রাণ প্রবেশ করতে পারলে লুটপাটের সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। গাজার মানুষ মরতে মরতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে। চরম খাদ্য সংকট তাদের বিকল্পহীন করে তুলেছে।”
গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় খান ইউনুসের বাসিন্দা আমাল নাবিল নামে এক মা বলেন, “গত তিনদিনে আমরা একবার ভাত খেয়েছি। আমার ছোট ছেলেটি এখন কথা বলে না—সে শুধু কাঁদে। আমি জানি না সে বেঁচে থাকবে কি না।”
চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং খাদ্যের অভাবে গাজার বেশিরভাগ হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। অনেক হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিট বন্ধ, গর্ভবতী মায়েদের অপারেশন থেমে গেছে। ডাক্তারদের হাতে ওষুধ নেই, রোগীদের হাতে খাবার নেই।
বিশ্বজুড়ে মানবাধিকারকর্মী ও ধর্মীয় নেতারা প্রশ্ন তুলছেন—“একটি আধুনিক রাষ্ট্র কিভাবে খাদ্যকে যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে?” পোপ ফ্রান্সিস, আইরিশ সংসদ সদস্য, ব্রিটিশ এমপি, এমনকি ইহুদি মানবিক সংগঠনগুলো পর্যন্ত ইসরাইলকে ‘নির্বিচার অবরোধ’ বন্ধ করতে আহ্বান জানিয়েছে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের সাবেক প্রধান জেইদ রা’দ আল হুসেইন বলেন, “গাজা আজ মানবতা ও নৈতিকতার পরীক্ষাগার হয়ে উঠেছে। এখানে ব্যর্থ হলে গোটা মানবসভ্যতা ব্যর্থ হবে।”
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বক্তব্য যে গাজায় কেউ না খেয়ে নেই—তা শুধু বাস্তবতা থেকে বিচ্যুতই নয়, বরং এ দাবি গাজার ক্ষুধার্ত শিশুদের মুখের উপর কঠিন উপহাস।
যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী নেতাও চোখে দেখা দুর্ভিক্ষের কথা বলছেন, যখন জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো একযোগে ইসরাইলকে দোষারোপ করছে, তখন নেতানিয়াহুর এ ধরনের বক্তব্য গোটা বিশ্বের মানবিক মূল্যবোধকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে।
গাজার পরিস্থিতি কোনো রাজনৈতিক যুক্তির বিষয় নয়, এটি এখন মানবতার সংকট। আর এই সংকটে বিশ্বের সামনে প্রশ্ন একটাই—আমরা কি চুপ করে বসে থাকব? নাকি মানবতার পক্ষে দাঁড়াব?
বাংলাবার্তা/এমএইচ