
ছবি: সংগৃহীত
জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস জোর দিয়ে বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের জন্য রাষ্ট্র গঠনের অধিকার কোনো পুরস্কার নয়—বরং এটি তাদের অবিচ্ছেদ্য মানবিক ও আন্তর্জাতিক অধিকার। সোমবার (২৮ জুলাই) জাতিসংঘ আয়োজিত ফিলিস্তিন ইস্যুর শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি নিয়ে এক উচ্চ-স্তরের আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। তুরস্কভিত্তিক বার্তা সংস্থা আনাদোলুর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে গুতেরেসের বক্তব্যের এই জোরালো বার্তা।
জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেস তার ভাষণে বলেন, “আসুন, বিষয়টি একেবারে পরিষ্কার করে বলি—ফিলিস্তিনিদের জন্য রাষ্ট্র গঠনের অধিকার কোনো পুরস্কার নয়। এটি একটি অধিকার, যা যুগের পর যুগ ধরে অস্বীকার করা হয়ে আসছে। রাষ্ট্র গঠনের এই অধিকার অস্বীকার করা চরমপন্থীদের হাতে উপহার তুলে দেওয়ার শামিল।”
তিনি আরও বলেন, “দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের পথ দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট হয়ে গেছে। সময় ফুরিয়ে আসছে। প্রতিদিন মানুষের বিশ্বাস হারিয়ে যাচ্ছে, প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে, আর ফিলিস্তিনিদের আশা একের পর এক ভেঙে যাচ্ছে।”
গুতেরেস তাঁর বক্তব্যে গাজা উপত্যকায় চলমান মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র তুলে ধরে বলেন, “গাজার উপর এক ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের ঝড় নেমে এসেছে। মানুষ জীবন ও সম্মান দুটো হারাচ্ছে। হাজার হাজার শিশু অনাহারে ভুগছে, এবং লাখ লাখ মানুষ চিকিৎসা, নিরাপত্তা এবং মৌলিক সেবা থেকে বঞ্চিত।”
তিনি সাম্প্রতিক সময়ে গাজায় কিছু মানবিক সহায়তার অনুমতি দেওয়ার বিষয়টিকে স্বাগত জানালেও বলেন, “আমি মানবিক সহায়তার ওপর কিছু বিধিনিষেধ কমানোর উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। কিন্তু স্পষ্ট করে বলি, এটি এই দুঃস্বপ্নের সমাপ্তির পথ নয়। বরং আমাদের এখনই প্রয়োজন—তাৎক্ষণিক এবং স্থায়ী যুদ্ধবিরতি, সকল জিম্মির নিঃশর্ত মুক্তি এবং পূর্ণ, নিরবচ্ছিন্ন মানবিক প্রবেশাধিকার।”
জাতিসংঘ মহাসচিব এসব শর্তকে কোনো শান্তিচুক্তির উপসংহার নয়, বরং “শান্তির মৌলিক ভিত্তি” হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, “এই তিনটি বিষয়—যুদ্ধবিরতি, মুক্তি, এবং সহায়তা প্রবেশ—শুধু শান্তির জন্য সহায়ক নয়, বরং এগুলোই শান্তির ভিত্তি গড়ে তোলে।”
গুতেরেস আরও বলেন, “পূর্ব জেরুজালেমসহ অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরাইলের অব্যাহত দখল আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। এটি অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। এটিই আইন। কোনো ধরনের দখলে প্রকৃত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় না।”
তিনি বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির নামে গত কয়েক দশক ধরে যেসব কূটনৈতিক প্রচেষ্টা হয়েছে, তার বেশিরভাগই ছিল শব্দ ও ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবে এগুলোর প্রভাব খুব কম। ফিলিস্তিনিরা এসব কথা বহুবার শুনেছে, বহুবার প্রতিশ্রুতি পেয়েছে, কিন্তু বাস্তবতা হলো—ধ্বংসযজ্ঞ থেমে নেই, দখলদারিত্ব অব্যাহত আছে।”
মহাসচিব গুতেরেস এক-রাষ্ট্রীয় সমাধানের বিপদের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “যদি এক-রাষ্ট্রীয় বাস্তবতা প্রতিষ্ঠিত হয় যেখানে ফিলিস্তিনিদের সমান অধিকার অস্বীকার করা হয়, এবং তাদের চিরস্থায়ীভাবে বৈষম্য ও দখলের মধ্যে বসবাস করতে বাধ্য করা হয়—তাহলে এটি কখনোই শান্তির পথ হতে পারে না। এটি ন্যায়বিচারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।”
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি গুতেরেস আহ্বান জানান, তারা যেন দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের পথে “জরুরি, সুনির্দিষ্ট ও অপরিবর্তনীয় পদক্ষেপ” গ্রহণ করে। তিনি বলেন, “ইসরাইলকে এখনই ‘স্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীনভাবে’ দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। একই সঙ্গে সব ধরনের এমন কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে যা এই সমাধানকে দুর্বল করে তোলে।”
জাতিসংঘ মহাসচিবের এই বক্তব্য বিশ্বব্যাপী কূটনৈতিক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মধ্যে নতুন করে আলোচনার ঝড় তুলেছে। বিশেষ করে এমন এক সময়ে যখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ—যেমন আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে, স্পেন—ইতোমধ্যে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং যুক্তরাজ্যের সম্ভাব্য স্বীকৃতির খবরও সামনে এসেছে।
এছাড়া, জাতিসংঘ প্রধানের এই জোরালো বক্তব্যের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহানুভূতি বা কূটনৈতিক শব্দবিন্যাস এখন যথেষ্ট নয়—সমাধানের জন্য জরুরি এবং বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ প্রয়োজন। রাষ্ট্রগঠনের এই অধিকার ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকারের অংশ—এটি কোনো করুণা বা পুরস্কার নয়। আর এটি অস্বীকার করা মানেই মধ্যপ্রাচ্যে সহিংসতার আরও গভীর খাত সৃষ্টি করা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ