
ছবি: সংগৃহীত
পনেরো বছরের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে মুক্তি পেতে চলেছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত সিনেমা ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’। পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়ের আন্তরিক প্রচেষ্টা, সময়ের প্রেক্ষাপটে চলচ্চিত্র নির্মাণের সংগ্রাম এবং অভিনেত্রী জয়া আহসানের প্রাণবন্ত উপস্থাপনায় ফের আলোচনায় এসেছে বাংলা সাহিত্যের এক অসামান্য রচনা ও তার পর্দার রূপান্তর।
চলচ্চিত্রে কুসুম চরিত্রে অভিনয় করেছেন দুই বাংলার জনপ্রিয় অভিনেত্রী জয়া আহসান। উপন্যাসের মতোই সিনেমায় কুসুম একজন বেপরোয়া, সাহসী, এবং আত্মসচেতন নারী— যে নিজের কামনা-বাসনার কথা লুকোয় না, বরং প্রকাশ করে সজোরে। এই প্রসঙ্গে জয়া বলেন,
"বরাবর নারীকেই কামনা ও বাসনার বস্তু হিসেবে দেখানো হয়েছে, কিন্তু কুসুম তা নয়। তারও নিজের চাওয়া-পাওয়া আছে। সে সেটা গোপন করে না। কুসুম একটা খোলা বইয়ের মতো, জড়তা নেই তার মধ্যে। এমন চরিত্র খুব কমই আসে একজন অভিনেত্রীর জীবনে।"
জয়া আরও বলেন, “শরীর দিয়ে মন ছোঁয়া যায়। আমার জীবনে শরীর আর মন— দুটোই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কুসুমও তাই।” এমন বলার মধ্যে দিয়ে অভিনেত্রী যেন কুসুমকে সময়ের পর্দা ছুঁয়ে বাস্তব দুনিয়ায় ফিরিয়ে আনেন।
২০০৬ সালে সুমন মুখোপাধ্যায় ঠিক করেছিলেন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন। কিন্তু লেখকের স্বত্ব, প্রযোজকের অনাগ্রহ, বাজেট সংকট— সবকিছু মিলে বছর পার হতে থাকে একটার পর একটা। এরপর ক্যালাইডোস্কোপ প্রযোজনা সংস্থার কর্ণধার সমীরণ দাস এগিয়ে আসেন, সমাধান হয় অনেক জটিলতার। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় অতিমারী। আরেকটু হলেই সব থেমে যেত চিরতরে।
তবে সুমন হার মানেননি। তিনি তখনও ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’-র শুটিং উপযোগী লোকেশন খুঁজে বেড়িয়েছেন রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। এমনকি শুটিংয়ের জন্য সম্ভাব্য স্থানগুলোর ভিডিও ধারণ করে রেখে দিয়েছেন যেন সময়মতো কাজে লাগে।
‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ উপন্যাস যেমন সমাজের গভীর অসাম্য ও চরিত্রগত টানাপোড়েন তুলে ধরেছে, তেমনি সুমনের সিনেমাও বর্তমান সমাজের বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত আলোচনাসভায় পরিচালক বলেন,
“১৫ বছর পরও গল্পটি প্রাসঙ্গিক। শশীর যেমন নিজের গ্রাম ছেড়ে বের হতে পারেনি, তেমনি আমিও নানা প্রতিকূলতার কারণে সিনেমা নির্মাণ শেষ করতে পারিনি। শশীর সীমাবদ্ধতা যেমন বাস্তব, তেমনি আমার সৃষ্টিশীল লড়াইও বাস্তব।”
এই সিনেমায় শশী ও কুসুম চরিত্রের মধ্যকার বৈপরীত্য যেন দুই দর্শনের সংঘাত। শশী বদ্ধ, দ্বিধাগ্রস্ত, আর কুসুম মুক্ত, আত্মবিশ্বাসী।
সুমন বলেন, “কুসুমের মন, শরীর ও আত্মা একরকম। সে একটানা প্রবাহমান সত্তা, জড়তাহীন। এই দিক থেকে সে অনেক বেশি আধুনিক। আমি নিজেও তার মতো হতে পারি না। সে এক ধরনের আত্মমুক্ত বাউল আত্মা, যেখানে ‘যা ভাঙে, তাই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে।’”
তিনি আরও বলেন, সিনেমার প্রতিটি চরিত্রই যেন আধুনিক সমাজের প্রতিচ্ছবি। ভাগ্যের হাতে নিয়ন্ত্রিত মানুষদের ঘিরে আবর্তিত হয় এই কাহিনি— একুশ শতকেও সেই নিয়ন্ত্রণ থেকে মানুষ কতটা স্বাধীন, সেটিই যেন প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয় দর্শককে।
উপন্যাসের বিখ্যাত সংলাপ ‘শরীর! শরীর! তোমার মন নাই কুসুম?’ নিয়ে চলেছে নানা আলোচনা। কেউ বলেন এটা শশীর সংলাপ, কেউ বলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবনা। পরিচালক সুমনের মতে, চিত্রনাট্যে এই দ্বিধা কাটিয়ে দেওয়া হয়েছে— স্পষ্টভাবে দেখানো হয়েছে, এটি শশীর দৃষ্টিভঙ্গি।
কিন্তু কুসুম সেই দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ করে। সে শরীরকে গোপন করে না, বরং আত্মপ্রকাশের একটি মাধ্যম হিসেবেই দেখে।
‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ শুধু একটি সিনেমা নয়, বরং সময়ের বাঁকে বাঁকে আটকে থাকা এক সৃষ্টিশীল নীরব যুদ্ধের প্রতীক। এটি একদিকে যেমন সাহিত্যের গভীরতা ধারণ করে, তেমনি অন্যদিকে জয়া আহসান, সুমন মুখোপাধ্যায় ও অন্যান্য শিল্পীদের নিবেদিতপ্রাণ অভিনয় এবং নির্মাণের মাধ্যমে সমকালীন সমাজের মুখোমুখি দাঁড় করায় দর্শককে।
জয়ার কণ্ঠে কুসুম, সুমনের ক্যামেরায় মানিক— মিলেমিশে তৈরি হয়েছে এক অনন্য, সাহসী, আবেগঘন সিনেমা। ১৫ বছরের প্রতীক্ষা শেষে সিনেমাপ্রেমীরা এবার দেখতে পাবেন সাহিত্যের পুতুলরা পর্দায় কতটা জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ