
ছবি: সংগৃহীত
গাজার আকাশে যখন যুদ্ধবিমানের গর্জন থামে, তখন কখনো কখনো ভেসে আসে আরেকটি আওয়াজ—বিমানের পেট থেকে নিচে পড়ে আসছে প্যারাসুটে বাঁধা ত্রাণ। কিন্তু এই দৃশ্য এখন গাজার হাজারো মানুষের চোখে মর্যাদাহানিকর এক অপমানের প্রতীক হয়ে উঠেছে। ক্ষুধায় কাতর, অস্তিত্বের সংকটে দিন কাটানো মানুষগুলোর কণ্ঠে উঠছে একটাই দাবি—“আমরা ভিক্ষা চাই না, আমরা অধিকার চাই।”
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় চলমান যুদ্ধ ও অবরোধের মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে আকাশপথে ত্রাণ পাঠানোর ঘটনা এখন প্রায় নিয়মিত হলেও, স্থানীয়দের অনুভূতি ভিন্ন। অনেক ফিলিস্তিনি মনে করছেন, এটি এক প্রকার “প্রদর্শনীমূলক মানবতা” যা মানুষের মৌলিক মর্যাদাকে পদদলিত করছে।
গাজার বাসিন্দা আহমেদ ফায়েজ ফায়াদ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, “আমরা কুকুর নই যে খাবারের জন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকব। আমরা রুটির জন্য মানুষের মতো মর্যাদাহীন লড়াই করব না। আমরা চাই একটি নিরাপদ, স্থিতিশীল জীবন। আমরা চাই আমাদের প্রাপ্য ন্যায্য অধিকার।”
তাঁর মতো অসংখ্য গাজাবাসী এখন মানবিক সহায়তা নয়, বরং রাজনৈতিক সমাধান ও আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা দাবি করছেন। ফায়েজের কথায় প্রতিফলিত হয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি জনগোষ্ঠীর হতাশা, যারা সহায়তার জন্য বাধ্য হলেও সেটিকে নিজের আত্মসম্মান রক্ষার পথে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখছে।
তিন দিন ধরে পরিবারের জন্য খাবার সংগ্রহ করতে না পেরে গাজার এক নারী, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, বলেন, “আমার শিশু ক্ষুধায় কাঁদে, আর আমি অসহায়। কিন্তু আকাশ থেকে একটা প্যাকেট পড়ে, সেটা ধরতে গিয়ে যদি আমার জীবন যায়, সেটা কি ন্যায়বিচার? সাহায্য নয়, আমি আমার মানুষের অধিকার চাই।”
গাজার শহর ও শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে এই ক্ষোভ এখন সাধারণ কথোপকথনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয়ভাবে একে বলা হচ্ছে “আকাশ থেকে অপমান”, যেখানে একটি সভ্য জাতির মতো বেঁচে থাকার পরিবর্তে মানুষকে তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উড়ে আসা খাবার সংগ্রহ করতে বাধ্য করা হচ্ছে।
ত্রাণ ফেলার কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন গাজাবাসী ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো। বিমান থেকে ফেলা ত্রাণের একটি বড় অংশ পড়ে যাচ্ছে গাজার উপকূলীয় এলাকায় কিংবা এমন জায়গায় যেখানে যুদ্ধবিধ্বস্ত ভবনের ধ্বংসস্তূপে পৌঁছানো অত্যন্ত বিপজ্জনক। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, প্যাকেট ভেঙে যাওয়ায় খাদ্যদ্রব্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
একজন ফিলিস্তিনি তরুণ বলেন, “আমি দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করেছি ত্রাণ প্যাকেট আসবে বলে। অবশেষে যখন একটি পড়ল, সেটি সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। আরেকটি মাটিতে পড়েই ভেঙে গেল। এভাবে আমাদের বাঁচানো যাবে না। আমাদের স্থায়ী সমাধান চাই, মর্যাদা নিয়ে বাঁচার সুযোগ চাই।”
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এই ত্রাণ সহায়তা পদ্ধতি মানবিক বিপর্যয়ের প্রকৃত রূপকে আড়াল করছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দায়মুক্তি দিচ্ছে। নিউ ইয়র্কভিত্তিক একটি সংস্থার বিবৃতিতে বলা হয়, “এটি এক ধরনের কৃত্রিম আশ্বাস, যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের বাস্তবতাকে ঢাকা দেওয়া হচ্ছে।”
জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তা, যিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, বলেন, “এই ব্যবস্থা কোনো সমাধান নয়। যদি আমরা গাজার প্রতিটি পরিবারের দোরগোড়ায় সহায়তা পৌঁছে দিতে না পারি, তাহলে এই সহায়তা মানবিকতার চেয়ে অনেক বেশি একটি ব্যর্থ প্রচারণা হয়ে দাঁড়ায়। অবরোধ প্রত্যাহার না হলে গাজার সংকট কখনোই কমবে না।”
গাজার এক শিক্ষক বলেন, “আমরা জাতি হিসেবে যদি অবরুদ্ধই থাকি, তাহলে প্রতিদিন আমাদের অপমানিত হতে হবে। একদিন খাবার ফেলা হবে, আরেকদিন সে খাবারের জন্য জীবন দিতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এখন প্রশ্ন: তারা কি শুধু খাবার ফেলবে, নাকি আমাদের মর্যাদাকেও সম্মান জানাবে?”
এই কথাগুলো শুধু এক ব্যক্তির নয়, গোটা গাজা উপত্যকার প্রাণভোমরা হয়ে উঠেছে। প্রতি মুহূর্তে যেখানে মৃত্যুর শঙ্কা, সেখানেও মানুষ মর্যাদার কথা বলছে। তারা বলছে, “আমরা ভিক্ষুক নই। আমরা যুদ্ধও চাই না। আমরা শুধু চাই আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের জমি, আমাদের ভবিষ্যৎ—একজন মানুষের মতো।”
গাজার আকাশে ত্রাণ ফেলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক সহানুভূতির প্রতীক হিসেবে, কিন্তু মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো তাকে দেখছে অপমানের চিহ্ন হিসেবে। ক্ষুধা, যুদ্ধ, অবরোধ, সহায়তা—সবকিছুর মাঝেও তারা এক জিনিসে একমত: ভিক্ষা নয়, অধিকার চাই।
এই প্রশ্ন আজ শুধু গাজার নয়, গোটা বিশ্বের বিবেকের জন্য—মানবতা কি শুধু প্যাকেটে খাবার ছুড়ে দেবে, না কি ফিলিস্তিনিদের মানুষ হিসেবে বাঁচার ন্যায্য অধিকারকেও স্বীকৃতি দেবে?
বাংলাবার্তা/এমএইচ