
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত বাংলাদেশ পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক হার কমানোর জন্য তৃতীয় দফার তিন দিনের আলোচনা শুরু হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার স্থানীয় সময় দুপুর সাড়ে ১২টায় যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) কার্যালয়ে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল প্রথম দিনব্যাপী বৈঠকে বসে। আলোচনা চলবে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত।
এই আলোচনায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, সঙ্গে রয়েছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরী এবং ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের শীর্ষ কর্মকর্তারা। সরকারি প্রতিনিধিদের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও কোম্পানির সঙ্গে আলাদা বৈঠকেও অংশ নিচ্ছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা, যেখানে পণ্য আমদানি বৃদ্ধির জন্য সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করার সম্ভাবনা রয়েছে।
গত ২ এপ্রিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেন, বাংলাদেশের মতো ৬০টি দেশের পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা হবে। তবে ৯ এপ্রিল এই শুল্ক প্রণালী তিন মাসের জন্য স্থগিত রাখা হয়। জুলাই মাসে ট্রাম্প নতুন করে ঘোষণা দেন, বাংলাদেশকে ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করা হবে, যা ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্যের গড়ে শুল্ক হার প্রায় ২২-২৩ শতাংশ, যা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ পাল্টা শুল্ক কমানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে পণ্য আমদানি বৃদ্ধি এবং বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর আশ্বাস দিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাকের সরবরাহ প্রধান বিষয় হলেও বাংলাদেশ বাণিজ্য ঘাটতি মাত্র ৬ বিলিয়ন ডলার, যা প্রতিবেশী প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামের চেয়ে অনেক কম। ভিয়েতনামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ১২৩ বিলিয়ন ডলার, তবু তারা মাত্র ২০ শতাংশ শুল্কে সমঝোতা করেছে।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে জানানো হয়েছে, আগামী এক থেকে দেড় বছরে বাণিজ্য ঘাটতি অনেক কমিয়ে এনে আমদানির পরিমাণ অন্তত দেড় বিলিয়ন ডলার বাড়ানো সম্ভব হবে। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানি বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ একটি প্যাকেজ প্রস্তাব করবে বলে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বয়িংয়ের কাছ থেকে ২৫টি উড়োজাহাজ কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এছাড়া সামরিক সরঞ্জাম, এলএনজি, সয়াবিন, তুলা এবং প্রতিবছর সাত লাখ টন করে গম আমদানির জন্যও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থান আগের চেয়ে নমনীয়। শুল্ক হার ১৫ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে আনার সম্ভাবনা রয়েছে, যা ভিয়েতনামের সঙ্গে তুলনামূলক সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান আগে জানিয়েছিলেন, গত ২৩ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের বিস্তারিত অবস্থানপত্র পাঠানো হয়েছে। তিন দিনের আলোচনার মাধ্যমে পারস্পরিক বাণিজ্য সম্পর্কিত কোনো চুক্তি স্বাক্ষর হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, “আমরা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত এবং তাদের সঙ্গে সমঝোতা করতে চাই। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকার জন্য আমাদের পণ্যের ওপর সুবিধাজনক শুল্ক হার প্রয়োজন।”
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষিত এই নতুন শুল্ক নীতির আগে, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্যে গড়ে প্রায় সাড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক ছিল। বর্তমানে তা বেড়ে ২২-২৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন ১৯ শতাংশ, জাপান ১৫ শতাংশ, যুক্তরাজ্য ১০ শতাংশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ১৫ শতাংশ শুল্কে সমঝোতা করেছে।
বাংলাদেশ এই চুক্তিগুলোর তুলনায় তার শুল্ক হার কমাতে চাইছে, যা দেশীয় পণ্যগুলোর প্রতিযোগিতার সুযোগ বাড়াবে।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা এই আলোচনার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশের পথ প্রশস্ত হবে বলে আশাবাদী। তারা মার্কিন কোম্পানির সঙ্গে পণ্য আমদানি ও রপ্তানি প্রসারিত করতে চায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং ব্যবসায়ী নেতারা যুক্তরাষ্ট্রে তাদের পণ্যের জন্য কার্যকর বাজার অধিকার পেতে কাজ করছে।
এই আলোচনার ফলাফল বাংলাদেশের বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলবে। শুল্ক হার কমিয়ে আনা গেলে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত নতুন দিশা পাবে এবং আমদানি বাড়ানোর মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো সম্ভব হবে। আগামী বৃহস্পতিবার এই তিন দিনের বৈঠক সমাপ্তির পর ফলাফল জানা যাবে, যা বাংলাদেশের বাণিজ্য নীতির জন্য এক বড় মাইলফলক হতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ