
ছবি: সংগৃহীত
চলতি বছর ২০২৫ শুরু থেকেই বাংলাদেশে স্বর্ণের বাজারে নজিরবিহীন অস্থিরতা বিরাজ করছে। বছরের মাত্র সাত মাসের মধ্যেই দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে স্বর্ণের দাম সমন্বয় করতে হয়েছে রেকর্ড ৪৫ বার। যা বিগত বছরের তুলনায় অনেক বেশি। বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) বলছে, এ বছর স্বর্ণের দাম বেড়েছে ২৯ বার, বিপরীতে কমেছে মাত্র ১৬ বার। এর ফলে চলতি বছরের প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত একের পর এক রেকর্ড গড়েছে স্বর্ণের দাম। বর্তমানে ২২ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণ বিক্রি হচ্ছে ১ লাখ ৭১ হাজার ৬০১ টাকায়।
বিশ্বব্যাপী চলমান অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, মার্কিন ডলারের দামের হঠাৎ উত্থান-পতন, ফেডারেল রিজার্ভের সুদহার সংক্রান্ত নীতিমালা ও অন্যান্য বড় অর্থনৈতিক ঘটনার প্রেক্ষাপটে সোনাকে এখন শুধু নিরাপদ বিনিয়োগ নয়, বরং লাভজনক ও স্মার্ট ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে বিবেচনা করছে অনেকেই। বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বর্ণের প্রতি আউন্স মূল্য এখন ৩,২৮০ থেকে ৩,৩৫০ ডলারের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। যদিও গত এপ্রিল মাসে এই মূল্য ছুঁয়ে গিয়েছিল রেকর্ড ৩,৫০০ ডলার পর্যন্ত। গোল্ডম্যান স্যাকস তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ৩,৭০০ ডলার পর্যন্ত উঠতে পারে। অন্যদিকে, জেপি মরগান ধারণা করছে, ২০২৬ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে এ মূল্য ৪,০০০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
২০২৫ সালের ১৫ জানুয়ারি বাজুস ২২ ক্যারেট স্বর্ণের ভরিপ্রতি দাম নির্ধারণ করে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৪৪৩ টাকা, যা ছিল বছরের প্রথম দফা মূল্যবৃদ্ধি। এরপর টানা ৭ দফায় ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখ পর্যন্ত স্বর্ণের দাম একাধিকবার বৃদ্ধি পায়। এর মধ্যে ১, ৬, ১০, ১৭ ও ২০ ফেব্রুয়ারি—প্রতিবারই রেকর্ড গড়ে স্বর্ণের দাম বাড়ানো হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি এটি পৌঁছে যায় ১ লাখ ৫৪ হাজার ৫২৫ টাকায়।
ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ ও মার্চের প্রথম দিনগুলোতে দাম কিছুটা কমলেও, এরপর ফের একের পর এক দফায় মূল্য বৃদ্ধি ঘটে। মার্চ মাসের ১৬, ১৮, ২৫ ও ২৮ তারিখে চার দফায় দাম বাড়ানো হয়, ফলে দাম গিয়ে ঠেকে ১ লাখ ৫৭ হাজার ৮৭২ টাকায়।
২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে মোট ৯ বার স্বর্ণের দাম সমন্বয় করা হয়—যার মধ্যে ৬ বার দাম বেড়েছে এবং মাত্র ৩ বার কমেছে। ২২ এপ্রিল ছিল সবচেয়ে আলোচিত দিন, যখন স্বর্ণের দাম সর্বোচ্চ রেকর্ড ভেঙে দাঁড়ায় ১ লাখ ৭৭ হাজার ৮৮৮ টাকায়। কিন্তু এরপরই ২৩ এপ্রিল এক দিনে ৫ হাজার ৩৪২ টাকা কমিয়ে বাজুস ঘোষণা করে, ২২ ক্যারেটের ভরিপ্রতি দাম ১ লাখ ৭২ হাজার ৫৪৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন হঠাৎ বড় ধরনের মূল্য হ্রাস বাজারে চাপ সৃষ্টির ইঙ্গিত দেয়। বিশেষ করে যারা বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে স্বর্ণ কিনেছেন, তাদের জন্য এটি এক ধরনের উদ্বেগজনক পরিস্থিতি।
মে মাসে স্বর্ণের দাম সমন্বয় করা হয় ১০ বার—এর মধ্যে সমান সংখ্যক ৫ বার করে দাম বাড়ে ও কমে। জুন মাসে দাম ২ বার বাড়ে ও ২ বার কমে। জুনের শেষে প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম হয় ১ লাখ ৭০ হাজার ২৩৬ টাকা।
জুলাই মাসে (এ পর্যন্ত) ৫ বার দাম সমন্বয় করা হয়েছে—৩ বার দাম বেড়েছে, ২ বার কমেছে। সবশেষ ২৪ জুলাই বাজুস আবারও দাম কমিয়ে ১ হাজার ৫৭৪ টাকা হ্রাস করে নতুন দাম নির্ধারণ করে ১ লাখ ৭১ হাজার ৬০১ টাকা।
বাজুসের স্ট্যান্ডিং কমিটি অন প্রাইসিং অ্যান্ড প্রাইস মনিটরিং-এর চেয়ারম্যান ও সহ-সভাপতি মাসুদুর রহমান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “বিশ্ববাজারে প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় স্বর্ণের দাম ওঠানামা করে। সে অনুযায়ী আমাদেরও দেশের বাজারে প্রতিনিয়ত সমন্বয় করতে হয়।”
বিশ্বব্যাপী এই অস্থিরতার মধ্যে অনেক কেন্দ্রীয় ব্যাংকও ডলার রিজার্ভের পরিবর্তে স্বর্ণ কেনাকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, চীন-মার্কিন উত্তেজনা, মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত—সব মিলিয়ে বিশ্বজুড়ে এক অনিশ্চয়তার আবহ বিরাজ করছে। ফলে অনেক বিনিয়োগকারী স্বর্ণকেই তাদের ‘হেজ অ্যাসেট’ হিসেবে বিবেচনা করছেন।
বিশ্বখ্যাত মার্কিন বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মরগানের মতে, চলতি বছর প্রতি প্রান্তিকে গড় স্বর্ণ চাহিদা থাকতে পারে প্রায় ৭১০ টন। এই উচ্চ চাহিদা বিশ্বের বিভিন্ন বাজারে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এদিকে, বিলিয়নিয়ার বিনিয়োগকারী জন পলসন ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, ২০২৮ সালের মধ্যে স্বর্ণের দাম প্রতি আউন্সে ৫,০০০ ডলার পৌঁছাতে পারে। তিনি বলেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ক্রয় এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য উত্তেজনার কারণে এই দাম বৃদ্ধি সম্ভাব্য।”
বিশেষজ্ঞরা একদিকে যেমন স্বর্ণের মূল্যবৃদ্ধিকে দীর্ঘমেয়াদি ‘স্মার্ট ইনভেস্টমেন্ট’ হিসেবে দেখছেন, অন্যদিকে তারা সতর্কও করছেন। কারণ, বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপট যদি হঠাৎ বদলে যায় বা যুক্তরাষ্ট্র আবারও সুদের হার বাড়িয়ে দেয়, তাহলে স্বর্ণের দামে হঠাৎ বড় ধস নামতে পারে।
স্বর্ণ একটি নিরাপদ আশ্রয় ঠিকই, কিন্তু এটি শতভাগ স্থিতিশীল নয়। তাই যেকোনো বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিশ্লেষণ, ঝুঁকি বিবেচনা এবং সময়জ্ঞান থাকা জরুরি।
২০২৫ সালের প্রথম সাত মাসে বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম ৪৫ বার পরিবর্তন, যা একটি রেকর্ড। এই পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতা, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপ এবং স্থানীয় চাহিদা। যদি আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল না হয়, তাহলে আগামী দিনগুলোতে আরও বেশি দাম সমন্বয়ের প্রয়োজন পড়তে পারে। আবার বাজারে স্বস্তি ফিরলে দামও স্থিতিশীল হতে পারে। এই অনিশ্চয়তার মধ্যেও স্বর্ণ তার ঐতিহ্যিক নিরাপদ বিনিয়োগের মর্যাদা ধরে রেখেছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ