
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ হিসেবে পরিচিত ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ’—ডাকসু। সেই ডাকসুর নির্বাচন হতে যাচ্ছে প্রায় ছয় বছর পর, আগামী ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫। ২০১৯ সালের পর নতুন করে আবারও ভোটের মাঠে নামার সুযোগ পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এই নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেমন উৎসাহ-উদ্দীপনা, তেমনি ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে শুরু হয়েছে জোর প্রস্তুতি, কৌশলগত হিসাব-নিকাশ এবং প্যানেল চূড়ান্তের তোড়জোড়।
নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে ২৯ জুলাই বিকেল ৪টায় এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ডাকসু নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন। তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন অন্যান্য রিটার্নিং কর্মকর্তারাও। তফসিল ঘোষণার পরই আলোচনায় উঠে এসেছে একটি প্রশ্ন—কে হবেন কার প্যানেলে?
যারা গত এক বছরে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন, জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান এবং ক্যাম্পাসে বিভিন্ন আন্দোলনে সামনের সারিতে ছিলেন, ছাত্র সংগঠনগুলো তাদেরকেই এবার প্রার্থী হিসেবে বিবেচনায় নিচ্ছে। সবার লক্ষ্য—চেনা, সাহসী এবং শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয় মুখদের নিয়ে গঠন করা একটি ভারসাম্যপূর্ণ, প্রতিনিধিত্বশীল এবং শক্তিশালী প্যানেল।
এবারের নির্বাচনে নারী ও সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। প্রায় সব ছাত্রসংগঠনই বলছে, তারা প্যানেল গঠনে নারী নেতৃত্ব, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং আদিবাসী শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল থেকে প্রার্থী হতে পারেন সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস, সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন, এবং আরও কয়েকজন সক্রিয় নেতা।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব জানিয়েছেন, “আমরা ডাকসু নির্বাচনকে স্বাগত জানিয়েছি। আমাদের প্রস্তুতি চলছে। যারা আন্দোলনে ছিলেন, ছাত্রস্বার্থে কাজ করেছেন, তাদের অগ্রাধিকার থাকবে। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারীরা আমাদের প্যানেলের মূল ভরকেন্দ্র।”
ছাত্রদলের ভেতর থেকে জানা গেছে, ‘গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, নির্বাচন ও প্রশাসনের ওপর ছাত্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, দমন-পীড়নের প্রতিবাদ, শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং হোস্টেল-ভর্তি সমস্যা’—এই বিষয়গুলোকে সামনে রেখেই তাদের ইশতেহার তৈরি হচ্ছে।
ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা থেকে সভাপতি এস এম ফরহাদ এবং সাবেক সভাপতি সাদিক কায়েম আলোচনায় রয়েছেন প্রার্থী হিসেবে।
এস এম ফরহাদ বলেন, “আমরা প্যানেলে এমন মুখ রাখবো যারা ক্যাম্পাসের আন্দোলনে বাস্তবিক অংশগ্রহণ করেছে। নারী ও সংখ্যালঘুদের যথাযথ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে। আমরা বিশ্বাস করি, প্রকৃত নেতৃত্ব জনগণের ভালোবাসা পায়, তারাই নির্বাচিত হবে।”
শিবির সূত্রে জানা গেছে, তারা এবার নির্বাচনকে একটি ‘প্রতিষ্ঠান পুনরুদ্ধার’ প্রক্রিয়া হিসেবে দেখছে। তারা চাইছে একটি স্বতন্ত্র ও ছাত্রস্বার্থভিত্তিক প্রশাসন গঠনের সুযোগ।
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, যারা জুলাই মাসের ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল, তারাও এবার পুরো প্যানেল ঘোষণা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এই সংগঠনের আহ্বায়ক আবু বাকের মজুমদার ও সদস্য সচিব জাহিদ আহসান আলোচনায় আছেন ডাকসুর সম্ভাব্য নেতৃত্ব হিসেবে।
জাহিদ আহসান বলেন, “জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মূল নায়করা আমাদের সঙ্গেই আছেন। আমরা চাই এমন একটা প্যানেল গঠন করতে, যা ভবিষ্যতের রাজনীতি ও নেতৃত্বে নতুন দিগন্ত খুলবে। নারীর অংশগ্রহণ আমাদের কাছে অগ্রাধিকার।”
গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের ভাষ্য, তারা শুধু আন্দোলন নয়, একাডেমিক ইস্যু, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং ডিন অফিসে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধের দাবিও তুলবে।
২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু হওয়া ছাত্র অধিকার পরিষদ এবার তাদের নিজস্ব প্যানেল গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। সংগঠনটির সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, “আমরা সংখ্যালঘু, নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণকে গুরুত্ব দিচ্ছি। সমান অধিকার ও সমান সুযোগই হোক নির্বাচনী শ্লোগান।”
এছাড়া এবারের নির্বাচনে একক প্রার্থী হিসেবে আগেভাগেই নাম ঘোষণা করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি বলেছেন, “এই ডাকসু হোক সকল বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক ঐক্যবদ্ধ ছাত্র কণ্ঠ।”
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মেঘমল্লার বসু নিজেও সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে বিবেচনায় রয়েছেন। ছাত্র ইউনিয়নের সূত্রে জানা গেছে, তারা ‘সাংগঠনিক শুদ্ধতা, রাজনৈতিক নৈতিকতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ’কে ভিত্তি করে প্রার্থী বাছাই করছে।
তারা বলছে, ডাকসু যদি একটি প্রকৃত ছাত্র সংসদ হয়, তাহলে সেখানে ছাত্রদের দাবি, অধিকার এবং ন্যায্যতা নিয়ে কাজ করার সুযোগ থাকতে হবে।
এবারের ডাকসু নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও বড় একটি ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারেন। অনেক স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী, যারা আগের অভ্যুত্থানে যুক্ত ছিলেন কিন্তু কোনো ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নন, তারাও নির্বাচনে অংশ নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিভিন্ন প্যানেলের বাইরে থাকা প্রার্থীদের ব্যক্তিগত পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা এবারের নির্বাচনে ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে।
দীর্ঘ বিরতির পর ডাকসু নির্বাচন ফিরে আসায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফিরে এসেছে একধরনের গণতান্ত্রিক উৎসবের আবহ। প্যানেল গঠনের পর্দার আড়ালের আলোচনা, সমর্থক জোট বাঁধা, ইশতেহার তৈরি—সব মিলিয়ে ক্যাম্পাসে ফিরছে রাজনৈতিক জীবন্ততা।
এখন দেখার বিষয়, কে কতটা গ্রহণযোগ্য, কতটা ছাত্রবান্ধব, আর কারা পারেন ছাত্রদের ম্যান্ডেট অর্জন করে ডাকসুকে আবার কার্যকর করতে।
আগামী ৯ সেপ্টেম্বর যে ভোট হবে, তা হবে শুধু একটি নির্বাচন নয়, বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ ছাত্র নেতৃত্ব বাছাইয়ের জন্য এক ঐতিহাসিক সুযোগ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ