
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বজুড়ে লিভার ক্যান্সারের প্রকোপ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে, এবং যদি এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে ২০৫০ সালের মধ্যে এই রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে বলে সতর্ক করেছে চিকিৎসাবিষয়ক খ্যাতনামা আন্তর্জাতিক সাময়িকী ‘দ্য ল্যানসেট’। গবেষণায় বলা হয়েছে, মদ্যপান, হেপাটাইটিস ভাইরাস সংক্রমণ এবং স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজন—এই তিনটি প্রধান ঝুঁকিপূর্ণ কারণ যদি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে না আনা যায়, তাহলে আগামী কয়েক দশকে লিভার ক্যান্সার বিশ্বব্যাপী এক ভয়াবহ স্বাস্থ্য সংকটে পরিণত হবে।
এই গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসকে ঘিরে, যাতে কেবল বর্তমান পরিস্থিতির বিশ্লেষণ নয়, ভবিষ্যতের চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। গবেষণাটি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য ও বিশ্লেষণ ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) ক্যান্সার গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ক্যানসার অবজারভেটরি (GCO)।
গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৮ লাখ ৭০ হাজার মানুষ লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। কিন্তু এই সংখ্যা আগামী ২৫ বছরের মধ্যে বেড়ে ১৫ লাখ ২০ হাজারে পৌঁছাতে পারে। শুধু আক্রান্তই নয়, মৃত্যুর হারও বেড়ে যাবে বিপজ্জনক হারে।
বর্তমানে লিভার ক্যান্সার হলো বিশ্বের ষষ্ঠ সর্বাধিক সাধারণ ক্যান্সার, কিন্তু এতে মৃত্যুহার এত বেশি যে এটি তৃতীয় সর্বোচ্চ প্রাণঘাতী ক্যান্সার হিসেবে তালিকাভুক্ত। গবেষকদের হিসাব অনুযায়ী, ২০৫০ সালে লিভার ক্যান্সারে মারা যেতে পারেন প্রায় ১৩ লাখ ৭০ হাজার মানুষ। এমনকি বর্তমানে প্রতি তিনজন আক্রান্তের মধ্যে দুইজনই সময়মতো পদক্ষেপ নিলে রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হতো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লিভার ক্যান্সার এমন একটি রোগ, যার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিরোধ সম্ভব। হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস প্রতিরোধী টিকা জন্মের পরপরই দেওয়া, রক্ত সঞ্চালনের সময় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, এবং অতিরিক্ত মদ্যপান পরিহার করলেই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
কিন্তু চিত্রটা মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। গবেষণায় বলা হয়েছে, এখনো অনেক উন্নয়নশীল দেশের—বিশেষ করে আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার—গরিব জনগোষ্ঠীর মাঝে হেপাটাইটিস-বি টিকাদানের হার উদ্বেগজনকভাবে কম। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে শুধু হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস সংক্রমণের কারণেই ২০১৫ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ মারা যেতে পারেন।
একসময় লিভার ক্যান্সারের মূল উৎস হিসেবে শুধু হেপাটাইটিস সংক্রমণকে দায়ী করা হতো। কিন্তু আধুনিক জীবনযাত্রায় অতিরিক্ত মদ্যপান ও স্থূলতাজনিত রোগগুলোও এখন বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গবেষণায় বলা হয়, ২০২২ সালে লিভার ক্যান্সারের ২১ শতাংশ ক্ষেত্রেই কারণ ছিল অতিরিক্ত মদ্যপান। কিন্তু ২০৫০ সালে এটি বেড়ে দাঁড়াবে ২৩ শতাংশে। একইভাবে, অ্যালকোহলবিহীন ফ্যাটি লিভার ডিজিজ, যা বর্তমানে পরিচিত ‘মেটাবলিক কর্মহীনতা-সম্পর্কিত চর্বিযুক্ত লিভার রোগ’ (MAFLD) নামে, সেটিও উদ্বেগের কারণ। এর ফলে ২০২২ সালে ৯ শতাংশ ক্যান্সার হয়েছে, যা ২০৫০ সালে ১১ শতাংশে পৌঁছাতে পারে।
MAFLD মূলত ডায়াবেটিস ও অতিরিক্ত ওজনের কারণে হয় এবং চিকিৎসকদের মতে, পশ্চিমা ধাঁচের খাদ্যাভ্যাস ও শহুরে জীবনধারা এর বিস্তারে ভূমিকা রাখছে।
গবেষণাটি এ-ও বলছে, ক্যান্সার চিকিৎসার উন্নয়নের পাশাপাশি এখন সবচেয়ে জরুরি হলো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি। এর মধ্যে রয়েছে:
হেপাটাইটিস-বি টিকা বাধ্যতামূলক করা ও সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা
জনসচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন পরিচালনা
মদ্যপান ও ধূমপান নিয়ন্ত্রণে কড়াকড়ি আইন প্রণয়ন
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও ওজন নিয়ন্ত্রণে জনস্বাস্থ্য কার্যক্রম
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নত দেশগুলোতে যেমন এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ছে, তেমনি নিম্ন-আয়ের দেশগুলোতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে রোগটি অনিয়ন্ত্রিত থেকে যাচ্ছে। ফলে প্রতিরোধযোগ্য হয়েও এই রোগের বিস্তার ঠেকানো যাচ্ছে না।
বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসে প্রকাশিত এই গবেষণার মূল বার্তা হলো, কেবল চিকিৎসা নয়, বরং সচেতনতা, শিক্ষা ও প্রাথমিক প্রতিরোধমূলক উদ্যোগই লিভার ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।
উন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এখনই সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নিতে হবে, না হলে অদূর ভবিষ্যতে এই ক্যান্সার বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর ভয়ানক চাপ তৈরি করবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ