
ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রাম বন্দরে বছরের পর বছর ধরে অপ্রয়োজনীয়ভাবে পড়ে থাকা কন্টেইনারের কারণে সৃষ্টি হওয়া পণ্যজট নিরসনে বড় ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ লক্ষ্যেই চট্টগ্রাম বন্দরে পড়ে থাকা মোট ৬ হাজার ৬৯টি কন্টেইনার নিলামের মাধ্যমে দ্রুত নিষ্পত্তির পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, এই সিদ্ধান্ত শুধু কন্টেইনারজট কমাবে না, বরং আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে গতিশীলতা আনার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির ওপরও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরের কনফারেন্স রুমে অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। উপস্থিত ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান, এনবিআরের বিভিন্ন স্তরের সদস্যরা, এবং কাস্টমসসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
সভায় জানানো হয়, দীর্ঘদিন বন্দরে পড়ে থাকা ৬০৬৯টি কন্টেইনার নিলামের মাধ্যমে বিক্রির পরিকল্পনা নিয়েছে কাস্টমস। এসব কন্টেইনার মূলত আমদানিকারকরা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে খালাস না করায় বন্দরে আটকে আছে। ফলে একদিকে যেমন বন্দরের জায়গার সঠিক ব্যবহার ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে সেগুলোর নষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও বাড়ছে।
এনবিআর চেয়ারম্যান জানান, এ সমস্যা সমাধানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ইতোমধ্যে একটি বিশেষ আদেশ জারি করেছে, যার আওতায় নিলামে অংশগ্রহণকারী সর্বোচ্চ দরদাতার কাছেই প্রথম নিলামের পরই পণ্য হস্তান্তরের বিধান রাখা হয়েছে। পূর্বে একাধিকবার নিলাম ডাকতে হতো, যা সময়ক্ষেপণ করত এবং প্রশাসনিক জটিলতা তৈরি করত। এখন এই নিয়মের ফলে একটি নিলামেই কার্যকরভাবে নিষ্পত্তি সম্ভব হবে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ইতোমধ্যে নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে ৫১৪৩টি কন্টেইনারের ইনভেন্টরি (তালিকা) কার্যক্রম শেষ হয়েছে। এই কাজে এনবিআরের ৭৯ জন কর্মকর্তা গত ছয় মাস ধরে কাজ করে চলেছেন। অবশিষ্ট ৯২৬টি কন্টেইনারের তালিকা আগামী অক্টোবরের মধ্যে সম্পন্ন করার আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে।
পুরো পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী বছরের জুনের মধ্যে ৫২৫০টি কন্টেইনার নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়া চলমান রাখতে ইতোমধ্যেই জাতীয় পত্রিকাগুলোর মাধ্যমে নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচার শুরু হয়েছে।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, এই উদ্যোগ চট্টগ্রাম বন্দরের কন্টেইনারজট অনেকাংশে কমিয়ে আনবে। ফলে বন্দরের অপারেশনাল সক্ষমতা বাড়বে, পণ্য খালাসে সময় কমবে এবং আমদানি-রপ্তানিকারকদের খরচ হ্রাস পাবে। এ অবস্থায় পণ্যের দামও তুলনামূলক কমবে, যার উপকার ভোগ করবেন সাধারণ জনগণ।
তিনি আরও বলেন, নিয়মিত ও দ্রুতগতির নিলাম কার্যক্রমের মাধ্যমে কন্টেইনার আটকে থাকা কমে গেলে ভবিষ্যতে অপ্রয়োজনীয় জট আর সৃষ্টি হবে না। এতে চট্টগ্রাম বন্দর আরও আধুনিক, কার্যকর ও ব্যবসা-বান্ধব হয়ে উঠবে।
সভায় বক্তারা বিশেষভাবে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের আন্তরিক প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন। নৌপরিবহণ উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল সংখ্যক কন্টেইনারের ইনভেন্টরি সম্পাদন করে নিলাম প্রক্রিয়া শুরু করাটা একটি বড় অর্জন। তিনি এই কাজে নিযুক্ত সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং এনবিআরকে ধন্যবাদ জানান।
তিনি বলেন, “চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। এই বন্দরকে আরও কার্যকর করতে হলে পণ্যের প্রবাহে কোনো বাধা রাখা যাবে না। দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া কন্টেইনারের জায়গায় নতুন পণ্য রাখতে পারলে আমদানি-রপ্তানির খরচ কমবে এবং সময় বাঁচবে।”
চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনারজট সমস্যা সমাধানের এই পরিকল্পনা শুধু একটি তাৎক্ষণিক সমাধান নয়, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রমের সূচনা। এনবিআর ভবিষ্যতে বন্দরের কনটেইনার ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত করতে ডিজিটাল নজরদারি, সময়সীমা নির্ধারণ, এবং দ্রুত নিষ্পত্তি ব্যবস্থা চালুর বিষয়ে কাজ করছে।
এই উদ্যোগের মাধ্যমে কাস্টমস ও বন্দর কর্তৃপক্ষ কেবল জায়গা খালি করছে না, বরং পুরো দেশের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের গতিশীলতায় এক নতুন মাত্রা যোগ করছে—যা দীর্ঘ মেয়াদে জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বড় অবদান রাখবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশাবাদী।
বাংলাবার্তা/এমএইচ