
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকার উত্তরা দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় নিজের জীবন উৎসর্গ করে অসংখ্য শিশুর জীবন রক্ষা করে গেছেন এক সাহসী নারী—শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরী। দুই সন্তানের মা মাহেরীন নিজের সন্তানদের কথা ভুলে গিয়েছিলেন না, বরং অন্যের সন্তানদের রক্ষা করাকেই নিজের মায়ের ধর্ম হিসেবে দেখে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করেছেন। প্রাণ দিয়েছেন, কিন্তু এক সেকেন্ডের জন্যও দায়িত্বে গাফিলতি করেননি।
তার স্বামী মনসুর হেলাল কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন, “আমি মাহেরীনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি তোমার নিজের দুই সন্তানের কথা একবারও ভাবলে না! সে বলেছিল, ‘ওরাও তো আমার সন্তান। ওদের একা রেখে আমি কী করে চলে আসি?’”—এই কথাগুলো যেন শুধুই এক মায়ের নয়, এক শিক্ষিকার আত্মত্যাগের প্রতিধ্বনি।
গত সোমবার (২২ জুলাই) দুপুর সোয়া ১টার দিকে ঢাকার উত্তরায় দিয়াবাড়ি এলাকায় বিকট শব্দ করে মাটিতে আছড়ে পড়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান। মুহূর্তেই ভয়াবহ বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ‘হায়দার আলী ভবন’ রক্তাক্ত ও জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির মতো রূপ নেয়। ভবনের ভেতরে থাকা ছোট ছোট শিশু শিক্ষার্থীদের জন্য সময় থমকে দাঁড়ায়। মুহূর্তেই বিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেণিকক্ষে দাউদাউ আগুনে বন্দি হয়ে পড়ে তারা। তাদের বেশিরভাগ ছিল তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী।
সেই ভয়াবহ মুহূর্তে সেখানে ছিলেন মাহেরীন চৌধুরী। তিনি ওই শাখার একাডেমিক সমন্বয়ক ছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, মাহেরীন চাইলে বের হতে পারতেন। দরজা খোলা ছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন তার শিক্ষার্থীদের নিয়েই ব্যস্ত। তিনি বারবার শিশুদের নিরাপদে বাইরে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। আর এই চেষ্টাতেই সময় চলে যায়। ধোঁয়া ও আগুনে আচ্ছন্ন হয়ে যান তিনি। তার শ্বাসনালি সম্পূর্ণরূপে পুড়ে যায়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কোমায় যাননি। কথা বলছিলেন। শেষ সময়ে তাকে নেওয়া হয় রাজধানীর জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে।
তার ভাই মুনাফ চৌধুরী বলেন, “দুর্ঘটনার কিছুক্ষণ পর কে যেন আমাদের পরিবারের একজনকে ফোনে জানিয়েছিলেন, ওনার অবস্থা গুরুতর। হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যাই। তখনও বোন বেঁচে ছিলেন। কথা বলছিলেন। কিন্তু অবস্থা ভয়াবহ ছিল। পরে চিকিৎসকরা নিশ্চিত করেন, তার শরীরের শতভাগ পুড়ে গেছে, শ্বাসনালি পুড়ে গেছে।”
চিকিৎসকদের চেষ্টায়ও শেষরক্ষা হয়নি। রাত ১০টা ১০ মিনিটে মাহেরীন চৌধুরী মৃত্যুর কাছে হার মানেন। অথচ হাসপাতালের আইসিইউতেও বেঁচে থাকার এক অসম্ভব লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। তাকে আশেপাশের লোকজন, ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা বের করে আনার সময়ও তার কণ্ঠে ছিল—“বাচ্চাগুলো বাঁচলো তো?”
মাহেরীনের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে শুধু রাজধানী নয়, দেশের বিভিন্ন জায়গায় শোকের ছায়া নেমে আসে। তার গ্রামের বাড়ি নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার বগুলাগাড়িতে তার মরদেহ পৌঁছালে সেখানে কান্নার রোল পড়ে যায়। গ্রামজুড়ে মানুষ ভিড় করেন তাকে এক নজর দেখার জন্য।
পরদিন (২৩ জুলাই) বিকাল সাড়ে ৩টায় বগুলাগাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনের কর্মকর্তা, শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ তাকে শেষ বিদায় জানাতে উপস্থিত হন। জানাজা শেষে তার মরদেহ দাফন করা হয় পারিবারিক কবরস্থানে, তার বাবার কবরের পাশে।
জানাজার আগে তার স্বামী মনসুর হেলাল বলেন, “আমার স্ত্রী আপনাদের অনেক ভালোবাসতেন। আজ আপনারা সবাই এসেছেন, এটিই তার প্রতি ভালোবাসার প্রমাণ। তিনি শুধু শহরে নয়, গ্রামের শিক্ষাবিস্তারেও কাজ করছিলেন। বগুলাগাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজের সভাপতির দায়িত্বও পালন করছিলেন তিনি। তার স্বপ্ন ছিল এই এলাকার শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নেওয়া।”
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জায়িদ ইমরুল মোজাক্কিন বলেন, “মাহেরীন চৌধুরী ছিলেন একজন আলোকিত মানুষ। তিনি কখনও অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। শিক্ষার জন্য কাজ করেছেন। এমন আত্মত্যাগী মানুষের মৃত্যু আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।”
মাহেরীন ছিলেন একজন সাহসী নারী, একজন দায়িত্বশীল শিক্ষক, একজন মমতাময়ী মা। কিন্তু তার সাহস, কর্তব্যপরায়ণতা এবং ভালোবাসা শুধু নিজের সন্তানদের জন্য ছিল না, ছিল গোটা জাতির ভবিষ্যৎ শিশুদের জন্যও। হয়তো এই কারণেই নিজের দুই সন্তানকে রেখে বহু মা-বাবার সন্তানকে বাঁচিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন তিনি।
মাহেরীন চৌধুরী বগুলাগাড়ি চৌধুরী পরিবারের সন্তান এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাতিজি। তিনি ঢাকায় পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষাজীবনে প্রবেশ করেন এবং একের পর এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করেন নিষ্ঠার সঙ্গে। শেষ জীবনে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে সমন্বয়কের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
আজ তার দুই সন্তান কাঁদছে—মা নেই বলে। কিন্তু তারা একদিন বড় হয়ে বুঝবে, তাদের মা শুধু তাদের মা ছিলেন না, তিনি ছিলেন সবার মা, এক সত্যিকারের নায়িকা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ