
ছবি: সংগৃহীত
বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ সংকটময় হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষ পারিবারিক ব্যয় সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। বিশেষ করে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণে অনেকেই কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার, যা নিয়ে আশার কথা থাকলেও বেসরকারি খাতের কর্মীদের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের এক সভায় সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানোর জন্য নতুন পে কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। কমিশনের প্রধান করা হয়েছে সাবেক অর্থ সচিব ও পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান জাকির আহমেদ খানকে। তাদেরকে ছয় মাসের মধ্যে একটি সুপারিশমূলক প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘১০ বছর পর বেতন কমিশন গঠিত হলো। গত দশকে মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু বেতন বৃদ্ধির সঙ্গে এর সঠিক সমন্বয় হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘সরকার মনে করছে, নতুন একটি বেতন স্কেল থাকা উচিত যা বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায়।’
দেশে বেকারত্ব দিন দিন বাড়ছে, বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে এবং নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে। এ অবস্থায় বেতন বাড়ালে মূল্যস্ফীতি আরও তীব্র হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারি বেতন বৃদ্ধির ফলে বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির চাপে বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি সব শ্রেণির মানুষের ওপর প্রভাব ফেলে, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে বেসরকারি খাতে বেতন বৃদ্ধির কার্যকর উদ্যোগ নেই। এর ফলে সামাজিক বৈষম্য আরও গভীর হবে।’ তিনি যোগ করেন, ‘সরকারের হাতে অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। মূল্যস্ফীতি কমানোর প্রচেষ্টার সঙ্গে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধির লক্ষ্য সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুন মাসে মূল্যস্ফীতি কমে ৮.৪৮ শতাংশে এসেছে, যা কিছুটা স্বস্তির। তবে গত এক বছরে ভোক্তা বাজারে পণ্যের দাম প্রকৃত দামের চেয়ে প্রায় ১০ শতাংশ বেশি হয়েছে। বিশেষ করে চালের দাম ক্রমবর্ধমান, যা দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বিশেষ চিন্তার বিষয়। এর মধ্যে সরকারি বেতন বৃদ্ধি হলে বাজারে মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়বে বলে অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করছেন।
দেশে প্রায় ছয় কোটি মানুষ কর্মসংস্থানে যুক্ত আছেন, যার মধ্যে আনুষ্ঠানিক খাতের বাইরে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। দীর্ঘদিন ধরে তাদের বেতন বেড়ে না যাওয়ায় তারা অর্থনৈতিক চাপে রয়েছে। বাড়িভাড়া, খাদ্য ও অন্যান্য জীবনের প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। করোনা মহামারি ও বৈশ্বিক সংকটের কারণে তাদের আর্থিক দুরবস্থা আরও গভীর হয়েছে। বেতন বৃদ্ধির সুযোগ না পেয়ে তারা হতাশায় ভুগছেন।
দেশে বর্তমানে সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। এরা মূলত ২০১৫ সালের বেতন স্কেলের আওতায় রয়েছেন। সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাসহ এমপিওভুক্ত শিক্ষকসহ সরকারি খাতে নিয়োজিত কর্মীর সংখ্যা প্রায় ২২ লাখের কাছাকাছি। পে কমিশনের সুপারিশের মাধ্যমে তাদের বেতন কাঠামো আপডেট করা হবে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারি বেতন বৃদ্ধির পাশাপাশি বেসরকারি খাতের কর্মীদের জন্যও প্রয়োজন সমন্বিত নীতিমালা গ্রহণের। এতে সামাজিক বৈষম্য কমানো এবং সমগ্র কর্মবাজারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভব হবে। পাশাপাশি মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান ক্ষুণ্ন না হয়।
সরকারকে বেতন কাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, বিনিয়োগের জন্য সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি ও সামাজিক নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। এক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের কল্যাণেও নজর দিতে হবে।
সরকার ১৫ লাখ সরকারি চাকরিজীবীর বেতন বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে, যা দেশের অর্থনীতিতে একদিকে আশার আলো বয়ে আনলেও অন্যদিকে বেসরকারি খাতের কর্মীদের ওপর চাপ বাড়াতে পারে। মূল্যস্ফীতির পরিবেশে এই সিদ্ধান্ত সামাজিক বৈষম্য বাড়িয়ে তুলতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন। প্রয়োজন সুষম ও সামগ্রিক নীতিমালা গ্রহণের।
বাংলাবার্তা/এমএইচ