
ছবি: সংগৃহীত
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় দীর্ঘদিন ধরে চলমান ইসরায়েলি অবরোধ ও হামলার প্রেক্ষাপটে মানবিক সংকট দিন দিন জটিলতর হচ্ছে। খাদ্য, পানি, ওষুধসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রীর ঘাটতি ও অবরোধের কারণে ক্ষুধা, অপুষ্টি ও দারিদ্র্যের যন্ত্রণা বহুগুণে বাড়ছে। এতে শুধু নয়, ছোট ছোট শিশুসহ বহু ফিলিস্তিনি প্রাণ হারাচ্ছেন প্রতিদিন। এই সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে বিশ্ব সম্প্রদায় নীরব থাকা নিয়ে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন গাজার সাধারণ মানুষ এবং কর্তৃপক্ষ। তারা আন্তর্জাতিক মানবিক আইন ও নৈতিকতার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলছেন—‘আমরা মারা যাচ্ছি, দয়া করে আমাদের বাঁচান।’
গত ২৪ ঘণ্টায় গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অপুষ্টিজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে আরো ৯ জন ফিলিস্তিনি মারা গেছেন। এতে গত অক্টোবর মাস থেকে এ পর্যন্ত অপুষ্টিজনিত মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২২ জনে। এদের মধ্যে অন্তত ৮৩ জন শিশু। শিশু ও বৃদ্ধদের মধ্যে অপুষ্টির ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুরা যখন নিয়মিত পর্যাপ্ত খাদ্য পাচ্ছে না, তখন তাদের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং সহজেই মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়।
গাজার হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার সুযোগও সীমিত। Khan Younis-এ অবস্থিত নাসের হাসপাতাল থেকে জানা গেছে, মাত্র ছয় মাস বয়সী এক শিশু অপুষ্টিজনিত জটিলতায় মারা গেছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে, শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্যের সরবরাহ এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়, যা মৃত্যুর হার বাড়াচ্ছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে দুনিয়া সম্প্রদায়কে তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছে, তারা অবিলম্বে গাজার সব ক্রসিং পয়েন্ট খুলে দিয়ে ত্রাণ ও জ্বালানিসহ প্রয়োজনীয় সাহায্য পৌঁছানোর ব্যবস্থা করবে না, তবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় এদেরই। বিশেষ করে ইসরায়েলি দখলদার সরকার, মার্কিন প্রশাসন, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্সসহ অন্যান্য পশ্চিমা সহযোগী রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য পূর্ণ দায়ী করা হয়েছে।
বিবৃতিতে আরও দাবি করা হয়েছে, গাজার প্রতিদিন অন্তত ৫০০টি ত্রাণবাহী ট্রাক এবং ৫০টি জ্বালানিবাহী ট্রাক প্রবেশের অনুমতি দিতে হবে যাতে দ্রুত দুর্ভিক্ষ বন্ধ করা যায়। এছাড়া বিশেষভাবে শিশুদের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা উচ্চারণ করা হয়েছে।
গাজার হাজার হাজার মানুষ তাদের বেঁচে থাকার অধিকার রক্ষার জন্য বিশ্বের দরবারে প্রার্থনা করছেন। তারা বলছেন, ‘আমরা মরছি, দয়া করে আমাদের বাঁচান।’ দীর্ঘদিনের অবরোধ, হাহাকার, ত্রাণের অভাব এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত জীবনে এভাবে মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়া গাজার মানুষের কষ্ট ও হতাশা অনস্বীকার্য।
বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও আন্তর্জাতিক সংস্থাও গাজার এই সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলছে, অবিলম্বে গাজার অবরোধ তুলে নিতে হবে, ত্রাণসামগ্রী ও ওষুধের প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে এবং শিশুদের সুস্থ্য ও সুরক্ষিত জীবন যাপনের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও রাষ্ট্রপুঞ্জের সদস্যরা ফিলিস্তিনিদের প্রতি নৈতিক ও মানবিক দায়বদ্ধতার কথা মনে করিয়ে দিয়ে বারবার বলছেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় সাধারণ মানুষের ওপর চাপ কমানো এবং মানবিক সাহায্য পৌঁছে দেওয়া এখন সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি। গাজার অবরোধ ও যুদ্ধবিরোধী কার্যক্রম দ্রুত অবসানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের শক্তিশালী উদ্যোগ ও দৃষ্টি আকর্ষণের দাবি জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
গাজা এখন এক ভয়াবহ মানবিক দুর্যোগের মুখে দাঁড়িয়ে। অপুষ্টি ও দারিদ্র্যে আক্রান্ত অসহায় মানুষ, বিশেষ করে শিশুদের জীবন রক্ষায় অবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশ্ব সম্প্রদায় যদি আর একবারও চুপ করে থাকে, তবে এটি শুধু মানবতার পরাজয়ই নয়, বরং এক ভয়াবহ মানবিক অপরাধের সাক্ষী হওয়া ছাড়া কিছুই হবে না।
গাজার মানুষের আকুতি, ‘আমরা মরছি, দয়া করে বাঁচান’, যেন গোটা বিশ্বকে এক বার জেগে উঠার আহ্বান করে। এই আহ্বানকে ঘিরে যদি আন্তর্জাতিক ন্যায় ও মানবিকতার জয় হয়, তবেই এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে।
সূত্র: আল জাজিরা, গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ