
ছবি: সংগৃহীত
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর ঘোষণায় নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়েছে মধ্যপ্রাচ্য ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। তিনি ঘোষণা করেছেন, ফ্রান্স জাতিসংঘের আসন্ন সাধারণ অধিবেশনে আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে। এই পদক্ষেপের পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, যা ভূরাজনৈতিক পরিসরে নতুন সমীকরণ তৈরি করতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বুধবার (২৪ জুলাই) রাতে এক সরকারি ঘোষণায় ফরাসি প্রেসিডেন্ট বলেন, “আমরা আর দেরি করতে পারি না। গাজায় চলমান যুদ্ধ, মানবিক সংকট, এবং মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা-রাজনীতিতে চলমান অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে আজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে যুদ্ধ বন্ধ করে বেসামরিকদের জন্য ত্রাণ নিশ্চিত করা এবং একটি কার্যকর ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যাওয়া।”
তিনি আরও বলেন, “হামাসকে নিরস্ত্রীকরণ করতে হবে এবং ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে ইসরাইলকে সম্পূর্ণ স্বীকৃতি দিতে হবে। কেবল তবেই এই রাষ্ট্র একটি আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য কাঠামো লাভ করবে।”
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইতোপূর্বে, চলতি বছরের ৯ এপ্রিল প্রথম ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, তার দেশ জুন মাসের মধ্যেই ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারে। যদিও তখন তার বক্তব্যটি আরও পর্যালোচনার প্রক্রিয়াধীন ছিল। এবার আনুষ্ঠানিকভাবে সেই ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ করলেন জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের সঙ্গে মিলিয়ে—যা অনুষ্ঠিত হবে সেপ্টেম্বর মাসে।
মার্কিন প্রশাসন ম্যাক্রোঁর ঘোষণাকে “বিপজ্জনক ও অনাকাঙ্ক্ষিত” হিসেবে অভিহিত করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স (পূর্বের টুইটার)-এ পোস্ট করে বলেন, “এই সিদ্ধান্ত কেবলমাত্র হামাসের প্রপাগান্ডাকে সহায়তা করবে। এটি একটি বেপরোয়া পদক্ষেপ, যা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে আরও পিছিয়ে দেবে।”
তিনি আরও বলেন, “ফ্রান্সের মতো একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাছ থেকে আমরা এমন সিদ্ধান্ত প্রত্যাশা করিনি। এটি ৭ অক্টোবরের হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য একপ্রকার অপমান।”
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলার পর ইসরাইল গাজায় গণহত্যা ও অবরোধের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানায়, যা এখন পর্যন্ত ৫৯ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণ কেড়েছে বলে দাবি করেছে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ। এই প্রেক্ষাপটেই ম্যাক্রোঁর সিদ্ধান্ত নতুন করে রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
ফরাসি সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তিনি বলেছেন, “এই স্বীকৃতি ইরানি প্রভাবাধীন আরও একটি গাজা তৈরির সমান, যা ইসরাইলকে ধ্বংস করার জন্য ব্যবহার হবে। এটি শান্তির জন্য নয়, বরং আরও সহিংসতার বীজ বপন করবে।”
তিনি এই সিদ্ধান্তকে “সন্ত্রাসকে পুরস্কৃত করার মতো” বলে উল্লেখ করেন।
অন্যদিকে, ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাটজ আরও কড়া প্রতিক্রিয়া দেন। সামাজিক মাধ্যমে দেওয়া তার এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “আমরা এমন কোনও ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠন হতে দেব না, যা আমাদের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলবে, আমাদের অস্তিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ করবে এবং আমাদের ঐতিহাসিক ভূমির ওপর অধিকার লঙ্ঘন করবে।”
তিনি ফ্রান্সের পদক্ষেপকে “সন্ত্রাসবাদীদের কাছে লজ্জাজনক আত্মসমর্পণ” এবং “হামাসের মতো খুনি-ধর্ষকদের পুরস্কৃত করা” বলেও মন্তব্য করেন।
বিশ্লেষকদের মতে, ফ্রান্সের এই ঘোষণাটি শুধু একটি কূটনৈতিক স্বীকৃতিই নয়, বরং এটি একটি আন্তর্জাতিক বার্তা—যেখানে পশ্চিমা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিকে এখন নৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রয়োজন হিসেবে দেখছে।
এর আগে স্পেন, আয়ারল্যান্ড ও নরওয়ের মতো ইউরোপীয় দেশসমূহ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যদিও তাদের এই স্বীকৃতিকে জাতিসংঘে পূর্ণ সদস্যতার জন্য যথেষ্ট বলে বিবেচনা করা হয়নি। তবে ফ্রান্সের মতো জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যের এমন সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে বলে মনে করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা।
এই ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের উপর আন্তর্জাতিক চাপ আরও বাড়বে বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা। বর্তমানে মার্কিন প্রশাসন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বছরে অবস্থান করছে এবং ইসরাইল অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকটে রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, ফ্রান্সের সিদ্ধান্ত তাদের জন্য একটি নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে এসেছে।
ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, গোটা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ফ্রান্সের এই সিদ্ধান্ত বিশ্ব কূটনীতিতে বড় একটি ঘটনা, যা আগামীতে ফিলিস্তিন-ইসরাইল দ্বন্দ্বে আলোচনার ধারা এবং শক্তির ভারসাম্যে প্রভাব ফেলতে পারে। তবে, শান্তি, সহাবস্থান ও সমাধানের পথ তৈরি হবে কি না, সেটিই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ