
ছবি: সংগৃহীত
মধ্যপ্রাচ্যের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের এক জটিল ও অনিশ্চিত প্রেক্ষাপটে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক বক্তব্য ফের নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তিনি বলেছেন, ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগঠন হামাস গাজায় যুদ্ধবিরতি চায় না, কারণ তারা শঙ্কিত—ইসরাইলি জিম্মিদের ছেড়ে দিলে তাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ কী হবে। এই মন্তব্য এমন এক সময়ে এলো, যখন কাতারে যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত একাধিক দফার আলোচনা ভেঙে পড়েছে এবং উভয় পক্ষই একে অপরের ওপর দোষ চাপাচ্ছে।
স্থানীয় সময় শুক্রবার (২৫ জুলাই) হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প বলেন, “আমরা শেষ কয়েকজন জিম্মির মুক্তির বিষয়ে কথা বলছি। কিন্তু হামাস বুঝে গেছে, তারা যদি সবাইকে ছেড়ে দেয়, তাহলে তাদের কী হবে তা তারা জানে না। এটাই তাদের ভয়।” ট্রাম্পের এই বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অবস্থান স্পষ্ট—ওয়াশিংটন গাজায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতির চেয়ে অস্থায়ী একটি সমাধানকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, যার মূল উদ্দেশ্য হলো বাকি জিম্মিদের মুক্ত করা।
ট্রাম্প আরও বলেন, “হামাস কোনো চুক্তিতে যেতে চায় না। তারা যেন মরতে চায়। এটি খুব, খুবই দুঃখজনক।” তার ভাষ্য অনুযায়ী, হামাস নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এতটাই আতঙ্কিত যে তারা এখন কোনো শান্তিচুক্তিতেই পৌঁছাতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। বরং নিজেদের শিকার বলেই মনে করছে। তিনি বলেন, “এই গোষ্ঠীটিকে শিকার বানানো হবে।”
এর আগে, বৃহস্পতিবার ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ সাংবাদিকদের বলেন, “হামাসের পক্ষ থেকে আমরা এখনো কোনো আন্তরিক আগ্রহ দেখতে পাইনি।” তিনি আরও জানান, যুক্তরাষ্ট্র আপাতত যুদ্ধবিরতির আলোচনায় নিজেদের ভূমিকা সীমিত করে আনছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি ইঙ্গিত করে যে যুক্তরাষ্ট্র এখন আর ‘বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতাকারী’ হতে চায় না, বরং ইসরাইলের দৃষ্টিকোণ থেকে একটি সীমিত কৌশলে ফিরে যাচ্ছে।
এদিকে, কাতারে চলমান যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত আলোচনায় ইসরাইলের পক্ষ থেকেও আগ্রহের ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই তারা আলোচনার টেবিল থেকে নিজেদের প্রতিনিধি দলকে সরিয়ে নিয়েছে। ইসরাইলি সরকার মনে করছে, যুদ্ধবিরতির ক্ষেত্রে হামাসের অবস্থান ধোঁয়াশাপূর্ণ এবং সময়ক্ষেপণমূলক।
এই প্রেক্ষাপটে হামাস যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানে বিস্ময় প্রকাশ করেছে। গোষ্ঠীটি এক বিবৃতিতে বলেছে, তারা “মধ্যস্থতাকারীদের প্রচেষ্টা সফল করতে আন্তরিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল।” হামাসের ভাষ্য অনুযায়ী, কাতার ও মিশরের মধ্যস্থতায় তারা যে গঠনমূলক ও ইতিবাচক অবস্থান দেখিয়েছে, সেটিকে উভয় দেশ স্বাগতও জানিয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের বক্তব্য তা অস্বীকার করছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, হামাস ও ইসরাইল—দুই পক্ষই এখন যুদ্ধবিরতির প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করলেও, বাস্তবসম্মত চুক্তির শর্ত নিয়ে তাদের মাঝে ব্যাপক মতবিরোধ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও এখন আর সংঘাত সমাপ্তির ব্যাপারে নেতৃত্ব দিতে চাইছে না। বরং তারা অপেক্ষা করছে—কবে হামাস জিম্মিদের ছেড়ে দেয় এবং তারপর কী ঘটবে।
অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়—বিশেষ করে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন—চলমান মানবিক বিপর্যয় নিরসনে জরুরি অস্ত্রবিরতির আহ্বান জানালেও, তা এখনো কার্যকর কোনো সমাধানে রূপ নেয়নি।
ইতোমধ্যে গাজায় অনাহারে মৃতের সংখ্যা ১২২ ছাড়িয়েছে। চিকিৎসা, খাদ্য ও নিরাপদ পানির চরম সংকটে পড়ে আছে লক্ষাধিক মানুষ। এমন অবস্থায় যুদ্ধবিরতির অচলাবস্থা আরও ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের দিকে পরিস্থিতিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে আশঙ্কা করছেন পর্যবেক্ষকরা।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই মন্তব্য যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনাকে আরও জটিল করে তুলেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। হামাস ও ইসরাইল উভয়ের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস, যুক্তরাষ্ট্রের সীমিত মধ্যস্থতা এবং কূটনৈতিক স্তরে স্থবিরতা—সব মিলিয়ে গাজায় শান্তির সম্ভাবনা এখন ক্রমশ ম্লান হয়ে আসছে। সংলাপের দরজা একবার বন্ধ হয়ে গেলে, মানবিক বিপর্যয়ের দায় ভবিষ্যতে কাদের ওপর বর্তাবে—তা নিয়েও শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক মহলে নতুন আলোচনা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ