
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে কর ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে দুর্নীতি—এমনই মন্তব্য করেছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান। তিনি বলেন, “দুর্নীতি শুধু কর আদায়ের গতি কমিয়ে দেয় না, বরং সাধারণ জনগণের মধ্যে কর দেওয়া নিয়ে আস্থার সংকট তৈরি করে।” দুর্নীতিমুক্ত ও কার্যকর রাজস্ব প্রশাসন গঠনে প্রয়োজন জবাবদিহি, সুশাসন, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং সমাজজুড়ে কর বিষয়ে সচেতনতা ও শিক্ষার বিস্তার।
শনিবার (২৬ জুলাই) রাজধানীর তেজগাঁওয়ে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (এফডিসি)-তে আয়োজিত এক ছায়া সংসদ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। “কর ব্যবস্থাপনায় সংস্কার” বিষয়ক এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি। অনুষ্ঠানটির সভাপতিত্ব করেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, “বাংলাদেশে কর সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা ও জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত। কর ব্যবস্থাপনা নিয়ে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাতেই কিছু নেই। প্রাথমিক, মাধ্যমিক কিংবা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে কর বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায়, একটি শ্রেণি কর সম্পর্কে আজীবন অজ্ঞাত থেকে যায়।” তিনি বলেন, “শুধুমাত্র উচ্চশিক্ষার কিছু বিষয়ের মধ্যে কর শিক্ষা সীমাবদ্ধ থাকায় সাধারণ মানুষ আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক), কাস্টমস ডিউটি ইত্যাদি বিষয়ে জানার সুযোগ পাচ্ছে না।”
তিনি মনে করেন, জনগণের মধ্যে কর বিষয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হলে কর শিক্ষাকে পাঠ্যসূচির অংশ করা জরুরি। “প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায় থেকেই যদি শিশু-কিশোরদের কর বিষয়ে ন্যূনতম ধারণা দেওয়া হয়, তাহলে ভবিষ্যতে তারা দায়িত্ববান করদাতা হয়ে উঠবে,” বলেন আবদুর রহমান খান।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, “দুর্নীতি প্রতিরোধে একমাত্র উপায় হচ্ছে জবাবদিহিতার পরিবেশ তৈরি করা। যেখানে জবাবদিহিতা থাকবে না, সেখানে প্রশাসনের কোনো বিভাগই দুর্নীতিমুক্ত থাকতে পারে না।”
তিনি আরও বলেন, “রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে কর ব্যবস্থায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা সহজ হয়। বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকায় আমরা কর প্রশাসনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারছি।”
তিনি খোলাখুলিভাবে স্বীকার করেন, “বর্তমানে সরকার যে পরিমাণ কর আদায় করে, তার চেয়েও বেশি কর অব্যাহতি দেয়। এটি কর ন্যায্যতা ও কর কাঠামোর ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়।”
এই সমস্যার সমাধানে এনবিআর ইতোমধ্যে কর আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানান চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, “নতুন আইনের মাধ্যমে সরকার নির্বিচারে কর অব্যাহতি দিতে পারবে না। জাতীয় স্বার্থে শুধুমাত্র জাতীয় সংসদের অর্থ বিলের মাধ্যমেই কর অব্যাহতি প্রদানের প্রস্তাবনা বিবেচনায় নেওয়া যাবে।”
এনবিআর চেয়ারম্যান আমদানি-রপ্তানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং (মূল্য কমিয়ে দেখানো) ও ওভার ইনভয়েসিং (মূল্য বাড়িয়ে দেখানো) নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “এটি শুধু রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার উপায় নয়, বরং বৈধ প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনৈতিক প্রতিযোগিতায় ফেলায় এবং জাতীয় অর্থনীতির ক্ষতি করে।”
তিনি বলেন, “বর্তমানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে এক ক্লিকে বিশ্ববাজারে পণ্যের প্রকৃত মূল্য জানা যায়। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্যাংক ও কাস্টমস কর্মকর্তারা সহজেই যাচাই করতে পারেন পণ্যের ইনভয়েস সঠিক কি না। কিন্তু এই বিষয়টি যথাযথভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না।”
করদাতাদের মধ্যে অডিট প্রসঙ্গে এক ধরনের ভয় কাজ করে বলে মন্তব্য করেন এনবিআর চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, “বিদ্যমান অডিট ব্যবস্থার কারণে করদাতারা মনে করেন, তাদের অযথা হয়রানি করা হবে।”
তবে এই সমস্যা নিরসনে প্রযুক্তিনির্ভর নিরপেক্ষ অডিট ব্যবস্থার ওপর জোর দেন তিনি। “যন্ত্র নির্ভর বিশ্লেষণ ও এলগরিদম নির্ভর রিস্ক-বেসড সিস্টেম চালু করলে অডিট প্রক্রিয়া আরও নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে,” বলেন আবদুর রহমান খান।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, “একটি শক্তিশালী, কার্যকর ও জনবান্ধব কর ব্যবস্থার জন্য ডিজিটাল রূপান্তর অত্যন্ত জরুরি। অনলাইন রিটার্ন দাখিল, ই-পেমেন্ট, অটোমেটেড অডিট, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার—এসবই আগামী দিনের কর ব্যবস্থার অঙ্গ।”
তিনি আরও জানান, এনবিআরের নতুন নীতিমালায় এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে ভবিষ্যতের চাহিদার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা চলছে। এতে করে করদাতারা হয়রানি ছাড়া তাদের দায় মেটাতে পারবেন এবং রাজস্ব প্রশাসনেও স্বচ্ছতা আসবে।
ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, “তরুণ সমাজকে কর সংস্কৃতি ও কর ন্যায়বিচার সম্পর্কে সচেতন করতে এই ছায়া সংসদ প্রতিযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।”
তিনি বলেন, “আমরা আশা করি আজকের শিক্ষার্থীরা আগামী দিনের সুশাসনের রূপকার হবে এবং কর ফাঁকি, অব্যবস্থা ও দুর্নীতিমুক্ত রাজস্ব প্রশাসন প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখবে।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ