
ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে গড়ে প্রায় ৩০ শতাংশ ট্যারিফ বা শুল্কহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘ প্রায় চার দশক পর এটাই প্রথমবারের মতো বন্দর ট্যারিফে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হলো। শুক্রবার (২৫ জুলাই) সকালে বন্দরের অবকাঠামো ও কার্যক্রম পরিদর্শন শেষে নৌ পরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন গণমাধ্যমকে এ সিদ্ধান্তের কথা জানান।
তিনি বলেন, "১৯৮৬ সালের পর এবারই প্রথম ট্যারিফ বাড়ানো হয়েছে। প্রায় ৩৮ বছর পর এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা অবশ্যই একটা যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তবে এ সিদ্ধান্ত হঠাৎ করে নেওয়া হয়নি। ট্যারিফ বাড়ানোর আগে দীর্ঘ দিন ধরে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা ও সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়েছে।"
উপদেষ্টা বলেন, "আমাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে দেশের প্রধান বন্দরটির সক্ষমতা আরও বাড়ানো। একইসঙ্গে এই বন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা, যাতে বৈশ্বিক বাণিজ্যে আমাদের অবস্থান আরও দৃঢ় হয়। ট্যারিফ বাড়ানোর ফলে রাজস্ব আয় বাড়বে, যা নতুন অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যবহার করা যাবে। তবে, এতে আমদানি ও রপ্তানির খরচ কিছুটা বাড়বে, যা ব্যবসায়ীদের কিছুটা চাপে ফেলতে পারে। আমরা আশা করি, তারা এটাকে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে দেখবেন।"
চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমে বিদেশি অপারেটরের সম্পৃক্ততা নিয়ে সম্প্রতি যেসব অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, তা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন নৌ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, "কিছু মহল বলে বেড়াচ্ছে, আমরা বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দিচ্ছি। এটা সম্পূর্ণ ভুল ব্যাখ্যা। বাস্তবতা হলো, আন্তর্জাতিক মানে বন্দরের দক্ষতা বাড়াতে হলে আন্তর্জাতিকভাবে অভিজ্ঞ অপারেটরদের সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। তবে বন্দরের সার্বিক প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা ও নীতিগত দিক পুরোপুরি সরকারের হাতেই থাকবে। কোনোভাবেই সার্বভৌমত্ব বা কর্তৃত্ব বিদেশি হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে না।"
তিনি আরও বলেন, "বন্দরের সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনায় দক্ষতা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। প্রতিবেশী দেশগুলো যেমন দ্রুত তাদের বন্দর আধুনিকায়ন করছে, আমরাও যদি পিছিয়ে থাকি, তাহলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ব।"
উল্লেখ্য, চলতি বছরের ৭ জুলাই চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালের (এনসিটি) পরিচালনার দায়িত্ব সাইপ পাওয়ার টেক লিমিটেড থেকে সরিয়ে নৌবাহিনীর হাতে দেওয়া হয়। এরপর থেকেই এনসিটির কার্যক্রমে আশানুরূপ উন্নতি দেখা যাচ্ছে।
বন্দর কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যমতে, হস্তান্তরের পর টার্মিনালে কনটেইনার হ্যান্ডলিং বা প্রক্রিয়াকরণে প্রায় ১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ৩ হাজার ২০০ একক (টিইইউ) কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা হচ্ছে। এর ফলে বন্দরের কার্যকারিতা ও পণ্য খালাসের গতি বেড়েছে, যা ব্যবসায়ী মহলেও প্রশংসা কুড়িয়েছে।
নৌ উপদেষ্টা আরও বলেন, "চট্টগ্রাম বন্দরকে আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে যেতে হলে আমাদের বন্দর ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তির আধুনিকীকরণ, দক্ষ জনবল ও আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন পরিচালনা কাঠামো দরকার। সেই লক্ষ্যেই আমরা বিদেশি অপারেটরদের সঙ্গে কাজ করছি। তবে এটা শুধুই বাণিজ্যিক অংশীদারিত্বের বিষয়—নির্বাহী ও নীতিগত সব সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ সরকারের।"
তিনি জানান, চট্টগ্রাম বন্দরে আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন, অটোমেশন কার্যক্রম, এবং শিপমেন্ট ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু করাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে, যার ফলে পণ্য খালাসের সময় ও খরচ উভয়ই কমে আসবে।
ট্যারিফ বৃদ্ধির কারণে আমদানি-রপ্তানিকারকদের মধ্যে কিছুটা উদ্বেগ দেখা দিলেও সরকার আশাবাদী যে, ট্যারিফ বাড়ানোয় রাজস্ব আয় যেমন বাড়বে, তেমনি উন্নয়ন ব্যয়েরও সংস্থান হবে। এতে বন্দরের অবকাঠামো সম্প্রসারণ, কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক শিপিং লাইনের কাছে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে বলে সরকারের আশা।
বিশ্লেষকদের মতে, চট্টগ্রাম বন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি জাতীয় সম্পদকে আধুনিক ও কার্যকর রাখতে হলে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত ও পরিবর্তন অপরিহার্য। তবে ট্যারিফ বৃদ্ধির বিষয়টি ব্যবসায়ীদের ওপর কতটা প্রভাব ফেলবে এবং তারা এটি কীভাবে গ্রহণ করবেন, সেটাই এখন মূল প্রশ্ন। সরকারের উচিত হবে তাদের সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনার মাধ্যমে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাধান নিশ্চিত করা।
সার্বিকভাবে, বন্দরের সাম্প্রতিক উদ্যোগগুলো দেশের অর্থনীতির প্রবাহকে গতিশীল করতে পারে, যদি তা দক্ষ ও স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ