
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে ব্যবহৃত কাস্টমস সফটওয়্যার ‘অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড’-এর প্রতি ব্যবসায়ীদের আস্থাহীনতা এবং ধারাবাহিক অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিকল্প একটি উন্নত সফটওয়্যার সিস্টেম চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছেন।
বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) এনবিআর সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত ‘রাজস্ব আহরণ ও অগ্রগতি পর্যালোচনা’ বিষয়ক এক গুরুত্বপূর্ণ সভায় এই সিদ্ধান্তের কথা জানান তিনি। সভায় এনবিআরের ভ্যাট ও কাস্টমস বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারা, দেশের সব কাস্টম হাউস ও ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনাররা উপস্থিত ছিলেন।
চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, “২০১৩ সালে কাস্টমস হাউসে অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সফটওয়্যার চালু হলেও তা ব্যবহারকারীদের কাঙ্ক্ষিত মানের সেবা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরেই ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে ধীরগতি, সার্ভার সমস্যাসহ নানা ত্রুটির অভিযোগ আসছে। এ অবস্থায় উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও কাস্টমস ম্যানেজমেন্টে নতুন ও আধুনিক সফটওয়্যার চালুর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।”
তিনি জানান, বিকল্প সফটওয়্যার সিস্টেমটি প্রণয়ন শেষে প্রথমে পাইলট প্রকল্প হিসেবে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হবে। পাইলটিং সফল হলে ধাপে ধাপে অ্যাসাইকুডার পরিবর্তে নতুন সফটওয়্যারে কাস্টমস ব্যবস্থাপনার সব কার্যক্রম স্থানান্তর করা হবে।
চেয়ারম্যানের বক্তব্য অনুযায়ী, ব্যবসায়ীদের অভিযোগের বেশিরভাগই অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমের সীমাবদ্ধতা ঘিরে। ধীরগতি, ফাংশনাল সীমাবদ্ধতা এবং বারবার সার্ভার ডাউন থাকায় আমদানি-রপ্তানিতে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা সরাসরি অভিযোগ করেছেন যে, এসব ত্রুটির ফলে তাদের পণ্য খালাসে দেরি হচ্ছে, অপারেশনাল খরচ বাড়ছে এবং ব্যবসা পরিচালনায় অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে।
চেয়ারম্যান সম্প্রতি ঢাকা কাস্টম হাউস, আইসিডি কমলাপুর, পানগাঁও, বেনাপোল ও মোংলা বন্দর পরিদর্শন করেন এবং সেখানেও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, আমদানি-রপ্তানিকারকসহ সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে অ্যাসাইকুডা সম্পর্কিত একাধিক সমস্যার কথা শোনেন।
সভায় এনবিআর চেয়ারম্যান কাস্টম হাউস, কাস্টমস গোয়েন্দা, ভ্যাট গোয়েন্দা ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল থেকে আমদানি-রপ্তানিকারকের বিন (BIN) নম্বর লক করার প্রতিটি ঘটনার পেছনের কারণ ও তা থেকে কত পরিমাণ অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় হয়েছে, তার বিস্তারিত প্রতিবেদন সরাসরি এনবিআরে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
তিনি বলেন, “প্রতিটি বিন লক একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। এটি যেন স্বেচ্ছাচারিতার রূপ না নেয় এবং এর মাধ্যমে যেন ব্যবসায়ী হয়রানির শিকার না হন, সে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। এতে রাজস্ব প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়বে।”
পণ্য খালাসের সময় বিলম্ব হলে, তার সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করে এনবিআরে প্রতিবেদন পাঠানোর নির্দেশ দেন চেয়ারম্যান। পাশাপাশি যেসব পণ্যের খালাস বিলম্বিত হয় বা যেসব বড় আমদানি লাইসেন্স আবেদন দীর্ঘ সময় ধরে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকে, সেগুলোর তথ্য সরাসরি রাজস্ব বোর্ডে প্রেরণের নির্দেশও দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, “আমাদের রাজস্ব আহরণের পাশাপাশি ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন (trade facilitation) বাস্তবায়নে বিলম্ব কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।”
চেয়ারম্যান একদিনের মধ্যে পণ্য খালাসের নির্দেশনা দিয়ে বলেন, পরবর্তী সময়ে পোস্ট ক্লিয়ারেন্স অডিট (PCA) এর মাধ্যমে ঝুঁকি মূল্যায়ন ও প্রয়োজনীয় পর্যালোচনা করা হবে। প্রতিটি কাস্টম হাউসকে এই PCA বিষয়ক প্রতিবেদন এনবিআরে নিয়মিতভাবে পাঠানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া, কাস্টমস রিস্ক ম্যানেজমেন্ট কমিশনারেট যাতে দ্রুত কার্যকর হয়, সেজন্য সদস্য (শুল্ক ও ভ্যাট প্রশাসন) কে অভিজ্ঞ ও দক্ষ জনবল পদায়নের নির্দেশ দেন তিনি।
অ্যাসাইকুডার বিকল্প ব্যবস্থা চালু নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও, এনবিআর চেয়ারম্যান ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করে বলেন, “আমরা এমন কোনো পরিবর্তন আনছি না, যা বাণিজ্যের গতিশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বরং উন্নতমানের সফটওয়্যারের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের সুবিধা আরও বাড়বে এবং রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থাও হবে আরও আধুনিক ও স্বচ্ছ।”
সব মিলিয়ে এনবিআরের সাম্প্রতিক এই ঘোষণা কাস্টমস ব্যবস্থাপনায় এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। একদিকে যেখানে সফটওয়্যারের ব্যর্থতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসায়ীদের ক্ষোভ ছিল, অন্যদিকে এখন একটি কার্যকর বিকল্প ব্যবস্থার আশ্বাস তাদের মধ্যে নতুন প্রত্যাশা সৃষ্টি করেছে। তবে শেষ পর্যন্ত বিকল্প সফটওয়্যার বাস্তবায়ন কতটা সফলভাবে করা যায় এবং সেটি ব্যবসা ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় কতটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
বাংলাবার্তা/এসজে