
ছবি: সংগৃহীত
এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষায় দায়িত্বশীলতার সর্বোচ্চ মানদণ্ড বজায় রাখা প্রত্যেক পরীক্ষকের জন্য বাধ্যতামূলক। তবে ২০২৫ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় এই দায়িত্বের গুরুতর ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন আটজন পরীক্ষক। তারা নিজেদের দায়িত্বপালনের পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের দিয়ে উত্তরপত্রের ওএমআর অংশ পূরণ করিয়েছেন, যা শুধু নিয়মবহির্ভূতই নয়, বরং পাবলিক পরীক্ষার নিরাপত্তা, নিরপেক্ষতা এবং স্বচ্ছতার ওপর সরাসরি আঘাত। এ ঘটনায় ঢাকা শিক্ষা বোর্ড তাদের সবাইকে আজীবনের জন্য অব্যাহতি দিয়েছে।
শনিবার (২৬ জুলাই) ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এসএম কামাল উদ্দিন হায়দার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই সিদ্ধান্ত জানানো হয়।
আজীবন অব্যাহতির তালিকায় যেসব শিক্ষক রয়েছেন, তারা বিভিন্ন জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করছেন। তারা হলেন—
১. মহসীন আলামীন, উচ্চতর গণিত শিক্ষক, সেন্ট যোসেফ হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সাভার
২. মো. সাখাওয়াত হোসাইন আকন, ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা শিক্ষক, যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ
৩. আবু বকর সিদ্দিক, সহকারী প্রধান শিক্ষক, মুন্সীনগর উচ্চ বিদ্যালয়, নবাবগঞ্জ, ঢাকা
৪. মো. আলেকজান্ডার মিয়া, গণিত শিক্ষক, সুল্লা আব্বাছিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, বাসাইল, টাঙ্গাইল
৫. মধুছন্দা লিপি, বাংলা শিক্ষক, বারৈচা কলেজ, বেলাবো, নরসিংদী
৬. মুরছানা আক্তার, ইংরেজি শিক্ষক, রোকেয়া আহসান কলেজ, ডেমরা
৭. মো. জাকির হোসাইন, বাংলা প্রভাষক, হাজী ইউনুছ আলী কলেজ, সাভার
৮. মো. রাকিবুল হাসান, বাংলা প্রভাষক, ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বার আনসার ভিডিপি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, কালিয়াকৈর, গাজীপুর
ঢাকা শিক্ষা বোর্ড জানায়, ২০২৫ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার সময় এই শিক্ষকরা উত্তরপত্রের ওএমআর (OMR) অংশ, যেখানে সাধারণত বৃত্ত পূরণ করতে হয়, তা নিজেরা না করে শিক্ষার্থীদের দিয়ে পূরণ করান। বিষয়টি ক্যামেরাবন্দি হয় এবং তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর এটি বোর্ড কর্তৃপক্ষের নজরে আসে।
বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর সংশ্লিষ্ট আট শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয়। নোটিশের জবাবে তারা নিজেদের দোষ স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তবে শুধুমাত্র ক্ষমা চাওয়ার ভিত্তিতে বোর্ড বিষয়টি হালকাভাবে নেয়নি।
শিক্ষা বোর্ড একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে এবং সব প্রমাণ-নথি যাচাই-বাছাই করে অভিযুক্তদের দায় পুরোপুরি প্রমাণিত পায়। এরপর বোর্ড সিদ্ধান্ত নেয়, শিক্ষা ব্যবস্থার শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ও ভবিষ্যতে অন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।
ফলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড এই আটজন পরীক্ষককে তাদের আওতাধীন ভবিষ্যতের সকল পাবলিক পরীক্ষার কার্যক্রম থেকে আজীবনের জন্য অব্যাহতি দেয়।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ড জানিয়েছে, শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে শিক্ষক ও পরীক্ষকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমন দায়িত্বজ্ঞানহীনতা শুধুমাত্র পরীক্ষার নিরপেক্ষতাকে ব্যাহত করে না, বরং গোটা সমাজে অবিচার ও অসুস্থ প্রতিযোগিতার জন্ম দেয়।
বোর্ড আরও জানায়, উত্তরপত্র মূল্যায়ন একটি গোপন ও গুরুদায়িত্বপূর্ণ কাজ। এখানে সামান্য অবহেলাও হাজারো শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দিতে পারে। এই ধরনের অন্যায় ভবিষ্যতে যাতে কেউ না করে, সে জন্যই এই কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, এই ধরনের সিদ্ধান্ত প্রয়োজন ছিল বহু আগে থেকেই। কারণ কিছু শিক্ষক পরীক্ষকের দায়িত্ব পাওয়ার পরও যথাযথভাবে কাজ না করে নিজের সুবিধার জন্য বিকল্প পথ বেছে নেন। এতে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি জনআস্থা হ্রাস পায়।
তবে অনেকে বলছেন, এই ধরনের অনিয়মের পিছনে শিক্ষা বোর্ডের তদারকির দুর্বলতাও দায়ী। তারা আরও কার্যকর প্রশিক্ষণ, নিরবচ্ছিন্ন পর্যবেক্ষণ এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থার ওপর জোর দেওয়ার আহ্বান জানান।
জাতীয় পরীক্ষায় শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা বজায় রাখতে বোর্ডের এই পদক্ষেপ প্রশংসনীয় হলেও, দীর্ঘ মেয়াদে এমন অনিয়ম রোধে একটি শক্তিশালী তদারকি ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি। কারণ, শিক্ষা ব্যবস্থার শুদ্ধতা নিশ্চিত না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আস্থা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যাবে না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ