
ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘদিনের সীমান্ত বিরোধ নতুন করে রক্তক্ষয়ী রূপ নিয়েছে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দুই দেশের সীমান্তের ছয়টি এলাকায় শুরু হয় গোলাগুলি, রকেট হামলা ও বিমান হামলা। এতে অন্তত ১২ জন থাই নাগরিক নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন আরও অনেকে। থাইল্যান্ড এ হামলার জবাবে কম্বোডিয়ার অভ্যন্তরে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান দিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালায়।
বিশ্লেষকদের মতে, সীমান্তে ছোট একটি গোলাগুলি থেকে শুরু হওয়া এই সংঘর্ষ এখন দুই দেশের মধ্যে সামরিক ও কূটনৈতিক উত্তেজনার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। উভয় দেশের জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলো আগুনে ঘি ঢালার মতো আচরণ করছে, যার ফলে এই সহিংসতা আরও দীর্ঘায়িত ও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সংঘাতের সূচনায় নিহত ও পাল্টা আঘাত
বৃহস্পতিবার ভোর থেকে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। সীমান্তবর্তী অন্তত ছয়টি পয়েন্টে গুলির লড়াই চলে টানা ঘণ্টার পর ঘণ্টা। গোলাগুলি ও রকেট হামলায় থাইল্যান্ডের অন্তত ১২ জন নাগরিক প্রাণ হারান, যাদের মধ্যে কয়েকজন বেসামরিক নাগরিক ছিলেন বলে স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে।
পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় থাই বিমান বাহিনী এফ-১৬ জঙ্গি বিমান ব্যবহার করে কম্বোডিয়ার সামরিক স্থাপনায় হামলা চালায়। সীমান্তের দুই পারেই সেনা সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে, মোতায়েন করা হয়েছে ভারী অস্ত্র।
ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ ও আগুনে ঘি
এই সংঘাতের মাত্র একদিন আগে সীমান্তে পুঁতে রাখা একটি ল্যান্ডমাইনে এক থাই সেনা তার পা হারান। তার আগেই, ১৬ জুলাই তিনজন থাই সেনা একইভাবে মাইন বিস্ফোরণে আহত হন। থাইল্যান্ড সরাসরি কম্বোডিয়াকে দায়ী করে জানায়, তাদের সেনারা ‘ইচ্ছাকৃতভাবে’ এই বিস্ফোরক বসিয়েছে।
তবে কম্বোডিয়া এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে দাবি করে, থাই সেনারা পুরোনো যুদ্ধকালে (যেমন খেমার রুজ যুগে) পুঁতে রাখা বিস্ফোরকের ওপর হেঁটে গিয়েছিল। এসব এলাকা এখনো ‘অতিমাত্রায় সংবেদনশীল’।
সীমান্ত বন্ধ, পণ্য ও সংস্কৃতি নিষিদ্ধ
থাইল্যান্ড সীমান্তে কঠোর নিয়ন্ত্রণ জারি করে। প্রাথমিকভাবে শুধু ছাত্র, চিকিৎসাপ্রার্থী ও জরুরি প্রয়োজনে যাতায়াত অনুমতি থাকলেও বৃহস্পতিবার থেকে পুরো সীমান্তই বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর পাল্টা জবাবে কম্বোডিয়া থাই চলচ্চিত্র, নাটক, টেলিভিশন অনুষ্ঠান ও থাই ভাষার সম্প্রচার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
সেই সঙ্গে থাইল্যান্ড থেকে আমদানিকৃত জ্বালানি, গ্যাস, ফলমূল ও শাকসবজির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। বন্ধ করে দেয় একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত বাণিজ্য চেকপোস্ট।
কূটনৈতিক সম্পর্ক অবনমন
থাই সরকার জানায়, কম্বোডিয়ায় নিযুক্ত থাই রাষ্ট্রদূতকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে এবং থাইল্যান্ডে নিযুক্ত কম্বোডিয়ান রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করা হচ্ছে। উভয় দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ‘ডাউনগ্রেড’ করে দুই পক্ষই আনুষ্ঠানিক দ্বন্দ্বের মাত্রা বাড়িয়েছে।
এই টানাপোড়েনের ফলে বহুপাক্ষিক আলোচনার পথ আপাতত বন্ধ হয়ে গেছে বলে মনে করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
বিরোধের ঐতিহাসিক পটভূমি
থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে ৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রেখা বহু দশক ধরেই বিরোধপূর্ণ। এর মূল সূত্রপাত ১৯০৭ সালে ফরাসি উপনিবেশিক শাসনামলে আঁকা একটি মানচিত্রকে ঘিরে, যেখানে কিছু সীমান্ত অঞ্চলকে কম্বোডিয়ার অংশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
থাইল্যান্ড এই মানচিত্রের বৈধতা অস্বীকার করে। ফলে নানা সময়ে সীমান্তে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত অঞ্চল হচ্ছে প্রায় এক হাজার বছরের পুরোনো প্রেয়া ভিহেয়ার মন্দির এলাকা।
১৯৬২ সালে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) কম্বোডিয়ার পক্ষে রায় দিলেও থাইল্যান্ড তাতে পুরোপুরি সন্তুষ্ট নয়। ২০১১ সালে নতুন করে সেখানে সংঘর্ষ হয় এবং আবারও আদালতের দ্বারস্থ হয় কম্বোডিয়া। ২০১৩ সালের রায়ে আইসিজে ফের কম্বোডিয়ার পক্ষে রায় দেয়।
বর্তমানে কম্বোডিয়া তৃতীয়বারের মতো আবারও আইসিজের কাছে যাচ্ছে, তবে থাইল্যান্ড স্পষ্ট জানিয়েছে, তারা এবার আন্তর্জাতিক আদালতের এখতিয়ার মানবে না। এই অবস্থান পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
অভ্যন্তরীণ রাজনীতির টানাপোড়েন সংঘাত বাড়াচ্ছে
থাইল্যান্ডের রাজনীতিতেও এই সীমান্ত সংঘাত নতুন মাত্রা যোগ করেছে। জুলাইয়ের শুরুতে ফাঁস হওয়া একটি ফোনালাপে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রাকে কম্বোডিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী হুন সেনকে ‘চাচা’ বলে সম্বোধন করতে শোনা যায় এবং থাই সেনাবাহিনীর তীব্র সমালোচনা করতে শোনা যায়।
এই ঘটনাকে ‘জাতীয় মর্যাদার অবমাননা’ বলে দাবি করে বিরোধীরা দেশব্যাপী বিক্ষোভ শুরু করে। এর জেরে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত হন এবং তার দল ফেউ থাই জোট সরকার থেকে শরিক ভুমজাইথাই পার্টি সমর্থন তুলে নেয়।
ফলে দেশে নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয় এবং বর্তমানে সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফুমথাম ওয়েচায়াচাই ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন।
যুদ্ধের আশঙ্কা ও আসিয়ানের দায়িত্ব
সীমান্তে সামরিক উপস্থিতি বাড়ছে। উভয় দেশের গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা ছড়ানো হচ্ছে। সীমান্তের সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন, উদ্বাস্তুর স্রোত শুরু হওয়ার আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন যেকোনো সামান্য ভুল বোঝাবুঝিও বৃহৎ আকারের যুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে আঞ্চলিক সংগঠন আসিয়ানের একটি সক্রিয় ভূমিকা নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দুই প্রতিবেশীর এমন সংঘাত শুধু দ্বিপাক্ষিক সমস্যাই নয়, বরং পুরো অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ